*ইশ! এবারের শীতটা মনে হয় একটু বেশিই পড়েছে।– এই বলেই কিংশুক বাবু স্ত্রী সূক্তিপ্রিয়াকে আরও জড়িয়ে ধরতে যায়। হালকা এক মুখ-ঝামটা দিয়ে সূক্তিপ্রিয়া বলেন- আমি কী কম্বল? ফায়ার প্লেস, হ্যাঁ?তুমি আমার সব। ফায়ার প্লেস বলো, কম্বল বলো আর সম্বলই বলো- তুমিই আমার সব, বুঝলে!- কিংশুক বাবু সূক্তিপ্রিয়ার নরম তুলতুলে বুকের ভেতর হাত বাড়াতে যায়।দু\'হাতে বেড়িবাঁধ তৈরি করে সূক্তিপ্রিয়া বলেন- এই বুইড়া বয়সে তোমার ভীমরতি হয়েছে নাকি!আহ! তুমি অমন করছো কেন?- বলেই একটু বল প্রয়োগ করে ডান হাতটা সূক্তিপ্রিয়ার বুকের নরম গদিতে বিছিয়ে ওম নিতে থাকে। সূক্তিপ্রিয়া আর বাঁধা দেননি। তবে সাবধান করে দিয়ে বলেন- এই যে মিস্টার বুড়ো, এই পর্যন্তই থেকো আর আগ বাড়তে চেষ্টা করো না।কিংশুক বাবু বিড়ালের বাচ্চার মতো চোখ জোড়া পিটপিট করে তাকাচ্ছে স্ত্রীর দিকে। এখনও ঘরের আলো নেভানো হয়নি। এটা ওদের অভ্যেস- ঘুমানোর আগে মিনিট কুড়ি আলো জ্বালিয়ে খোশগল্প করা। তারপর ঘুমের রাজ্যে ডুব দেয়া।সূক্তিপ্রিয়া কিংশুক বাবুর চোখে চোখ ফেলে বলেন- তুমি বিড়ালের বাচ্চার মতো অমন চোখ পিটপিট করছো কেন?ভালো লাগছে তাই। আহ! কী শান্তি।শান্তি না, ছাই! আমার ওসব এখন আর ভালো লাগে না।উত্তরে কিংশুক বাবু নির্বিকার।হাতটা একটু নড়াচড়া করতেই সূক্তিপ্রিয়া শাসনের সুরে বলেন- এই যে মহাশয় আর এগোনো চলবে না। আমি কিন্তু বাড়া ভাতে ছাই ঢেলে দেবো। যতটুকু পাচ্ছো তা\'তেই সন্তুষ্ট থাকো।মুচকি হেসে কিংশুক বাবু বলেন- আরে তুমি ভয় পাচ্ছো কেন?ভয় পাবার কী আছে? ওসব আমার এখন একদম ভালো লাগে না। বিরক্ত লাগে!কিংশুক বাবু মুচকি হেসে বলেন- ঠিকই বলেছো, এখন আর তেমন মধুময় লাগে না। লবণ ছাড়া সাদা ভাতের মতো লাগে।– এই বলেই সূক্তিপ্রিয়ার ঊরুর ভেতর কিংশুক বাবু একখান পা ডুবিয়ে দিলেন। সূক্তিপ্রিয়া আর কোন কথা না বাড়িয়ে বললেন- আর কোন ডিস্টার্ব করো না এখন। শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।ঠিক আছে। আর কোন বিরক্ত করবো না।– বলেই আলোটা নিভিয়েই ডীমলাইটটা জ্বালিয়ে দিলেন কিংশুক বাবু। তারপর স্ত্রীকে টেনে বুকের মধ্যে নিয়ে ওম নিতে থাকেন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই স্ত্রী সূক্তিপ্রিয়া ঘুমের রাজ্যে ডুবে গেলেন। দেখতে দেখতে শান্ত, স্নিগ্ধ, অপরূপা লাগছে। দেখতে লাগছে ঠিক- জীবনে না-দেখা পরীর মতো। সকল চঞ্চলতা এখন নিবিড় শান্ত হয়ে লুটোপুটি খাচ্ছে সূক্তিপ্রিয়ার মুখমণ্ডলে। আবছা আলোয় সত্যিই স্বর্গীয় মনে হচ্ছে।কিংশুক বাবু মুগ্ধ নয়নে স্ত্রীকে দেখছেন আর ভাবছেন নানান কথা; মানুষ সত্যিই বিচিত্র। জেগে থাকা মানুষের রূপ এক বিচিত্ররূপের সমাহারে সমৃদ্ধ আবার ঘুমের মধ্যে বদলে যায় তার সকল চঞ্চলতা। এক স্বর্গীয় অবয়ব চেহারায় ফুটে থাকে। ঘুমন্ত সকল মানুষকেই নিশ্চয়ই এমন মনে হয়। ঘুমের মধ্যেই সূক্তিপ্রিয়া মুচকি হেসে ওঠলেন। কিংশুক বাবুর বুকের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে একাকার; এই মুচকি হাসিতেই যেন সূক্তিপ্রিয়াকে অন্যরকম মনে হচ্ছে। মুহূর্তেই নিরূপমা এসে মনের ভেতর হামলে পড়লো...কিংশুকের গ্রীবায় আলতো ছুঁয়ে নিরুপমা বলল- তোমাকে দেখতে দেখতে আমি পাগল হয়ে যাবো!আমি দেখতে আর তেমন হলাম কোথায়?- কিংশুক মুচকি হেসে বলে।নিরুপমা একগাল স্নিগ্ধ হাসি ছড়িয়ে বলে- তুমি আমার কাছে রূপকথার রাজপুত্তুর।– বলেই একদৃষ্টে চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকে।পড়ন্ত দুপুর। গাছের মগডালে ঘুঘু পাখিটা নিশ্চিন্তে মধুর কন্ঠে ডেকেই চলছে। আর মনপ্রাণ ব্যাকুল করে দিচ্ছে ঝিরিঝিরি বাতাসের ছোঁয়ায়। এই স্থানটা একটু নির্জন। গ্রামের পাশেই কিন্তু কিছুটা দূরে; বিলের পাশেই পড়ে থাকা বাগানবাড়ি। লোকজনের আনাগোনা নেই বললেই চলে। পাশেই পদ্মবিলে হাজার রকমের জলপদ্ম ফুটে আছে। যেন খুশীর জোয়ার বইছে চারদিকে। নিরুপমা নিজেকে আর সামলাতে পারলো না- আচমকা এক চুমু বসিয়ে দিলো কিংশুকের কপোলে।কিংশুক থরথর কাঁপছে। হাসির ঝর্ণা আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে দিয়ে নিরুপমা বলে- তুমি অমন ভয় পাচ্ছো কেন?কিংশুক কম্পিত কন্ঠে বলে- যদি কেউ দেখে ফেলে, তবে!চোখ দুটো হরিণীর মতো টেনে টেনে নিরুপমা বলে- তুমি আমাকে ভালোবাসো না?হ্যাঁ, খুব ভালোবাসি।তাহলে ভয় কিসের?না, মানে...।– কিংশুক কম্পিত কন্ঠেই বলতে চেষ্ঠা করে।কোন মানে নেই।– বলেই নিজের কপোল দেখিয়ে নিরুপমা আবারও বলে- তুমি একখান দাও।কিংশুক যেন আচমকা আকাশ থেকে ছিটকে পড়লো। চোখ জোড়া বড়বড় করে আশ্চর্যভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। অমন হা করে কী দেখছো?- নিরুপমার হাসিতে যে বনের পাখিরা মিষ্টিসুরে গেয়ে ওঠল- তোমরা খুশীতে মেতে যাও!কিংশুক এখনও সম্বিৎ ফিরে পায়নি। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে- সকল ভালোবাসা, ভালোলাগা, মুগ্ধতা আর স্নিগ্ধতা যেন ওকে পুরোপুরি গ্রাস করে নিয়েছে। সে খুশীতে আর আনন্দে হতবিহ্বল।অভিমানী কন্ঠে নিরুপমা বলে- তুমি যদি আমার ভালোবাসাটুকু আমাকে না ফিরিয়ে দিচ্ছো তাহলে ধরে নেবো, তুমি আমাকে ভালোবাসো না।কিংশুক লাজুক চোখে চারপাশে তাকাচ্ছে আর আমতা আমতা করছে- কিন্তু!কোন কিন্তু নয়।– অভিমানী নিরুপমা গাল ফুলিয়ে ঘাসের বুকে তাকিয়ে রইলো।হঠাৎ কম্পিত ঠোঁটের স্পর্শে নিরুপমা নিজেকে আর সামলাতে পারলো না। দু\'হাতে কিংশুককে জড়িয়ে ধরলো। দু\'জন স্বর্গীয় ভালোবাসার মোহনায় ভেসে কিছুক্ষণ নিঃস্তব্ধ। জীবনের প্রথম চুম্বন আর পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে থাকা এক স্বর্গীয় সুখ। এখন দু\'জনই লাজুক দৃষ্টিতে ঘাসের বুকে চিমটি কাটছে। সেই থেকে নিরুপমা আর কিংশুক ভালোবাসার ইন্দ্রজালে আবদ্ধ। একজন অন্যজনকে ছাড়া জীবনকে কল্পনাই করতে পারে না। ওদের নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে ভালোবাসার রঙ ছড়ায় প্রতিক্ষণে।*অন্য এক বিকেল। এই এখানে ওরাই দু\'জন। কিন্তু নিরুপমার মনে হাসি নেই। কিংশুকের কাঁধে ঝুলছে ব্যাগ। নত মস্তকে দু\'জনই চুপচাপ দাঁড়িয়ে। নীরবতা ভেঙে কিংশুক বলে- লক্ষীটি আমার, তুমি মন খারাপ করো না। যুদ্ধে আমরা না গেলে দেশ কেমনে স্বাধীন হবে! অনেকেই যাচ্ছে। তুমি না গেলেও চলবে।– বলেই কিংশুকের একটা হাত টেনে ধরে।না, নিরুপমা। এই আমার মতো আমাকে নিয়েই তো অনেকে। আমি চুপচাপ বসে থাকলে চলবে না। আমি বাড়িতে কিছুই বলে আসিনি। মা খুব কান্নাকাটি করবে।নিরুপমা অবাক নয়নে তাকায়- এ তো সেই কিংশুক নয়। অন্য এক কিংশুক; বুক টান করা যোদ্ধা কিংশুক। ওকে ফেরানো যাবে না। তবুও দু\'হাতে কিংশুকের হাত চেপে ধরে বলে- তোমাকে ছাড়া আমি কীভাবে থাকবো।এইতো যাবো, দেশ স্বাধীন করেই ফিরে চলে আসবো।– কিংশুকের দীপ্ত উচ্চারণ। নিরুপমা চুপচাপ। অশ্রুজল দু\'নয়নের কোণ বেয়ে টপটপ করে পড়ছে।শোন লক্ষীটি, কান্না করো না। দেখবে আমার কিচ্ছু হবে না।নিরুপমা এবার ডুকরে কেঁদে ওঠলো। তুমি অমন করছো কেন?আনন্দে আর ভালোলাগায়।– বলেই নিরুপমা কিংশুককে জড়িয়ে ধরে। আর জড়িয়ে ধরেই সোহাগী কন্ঠে বলে- কিংশুক, তোমাকে আমি শুধু ভালোইবাসি না, আজ থেকে আমার বুকের ভেতর শ্রদ্ধার আসনেও বসালাম। তুমি আমার ছিলে, আছো এবং থাকবে। তুমি যুদ্ধে যাও। আর কোন চিন্তা করো না। তোমার মাকে আমি দেখে রাখবো।নিরুপমাকে দু\'হাতে চোখের সামনে টেনে এনে আশ্চর্যভরা দৃষ্টিতে তাকায়।হ্যাঁ, আমি বলছি।এবার কিংশুক নিজেকে আর সামলাতে পারলো না। নিরুপমাকে বুকে টেনে নিয়ে বলে- আমি জানতাম, তুমি আমাকে আটকাবে না।নিরুপমা মনে মনে ভাবে- তোমাকে আর কে আটকাবে! মায়ের বাঁধনই যেখানে তোমাকে আটকাতে পারেনি!নীরবতা ভেঙে কিংশুক বলে- হাবিব আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। এখনই রওনা হতে হবে। যাবার বেলায় শুধু একবার হাসো। তোমার হাসিমাখা মুখটুকু নিয়েই আমি যুদ্ধে যেতে চাই।নিরুপমা অশ্রুসিক্ত চোখে হাসতে হাসতে কিংশুককে কাছে টেনে ভালোবাসার চুম্বন বসিয়ে দেয়। উজ্জীবিত কিংশুক বুকখান টান টান করে পা ফেলে এগিয়ে চলে যায় যুদ্ধে। আর একবারও পেছন ফিরে তাকায়নি।বাড়ি ফিরতি পথে নিরুপমা কাবিল মিয়ার মুখোমুখি হয়। কোন কিছু না-বলেই নিরুপমা চলে যাচ্ছিল। কাবিল মিয়ার ডাকে সে দাঁড়ায়।কোথায় গিয়েছিলে মা নিরুপমা?- বলেই হাতের পদ্মজোড়ায় তাকায়।চাচা, আমি বিলে গিয়েছিলাম।হাতে পদ্মফুল দেখছি। একেবারে ফুটন্ত পদ্মফুল। তা\'ও আবার একজোড়া। বাড়িতে পূজা আছে বুঝি!- কাবিল মিয়া মিষ্টি-দুষ্ট হাসি হেসেই যাচ্ছে।ম্লান মুখে নিরুপমা বলে- হ্যাঁ চাচা।নৌকায় করে ওটা কে গেল? মহীতোষ মাস্টারের ছেলে বুঝি?- বলেই উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকে।আমি জানি না চাচা। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, আমি আসি চাচা।– এই বলে নিরুপমা আর দাঁড়ায় না। কাবিল মিয়া নীরব দৃষ্টিতে নিরুপমার চলে যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকে। আর মনে মনে যেন কী ভাবে... সে-ই জানে।*পাঁচ মাস পর...হাবিব ও কিংশুক পাশাপাশি হাঁটছে বীরের বেশে। দু\'জনের কাঁধেই বন্দুক, রুগ্ন চেহারা, মলিন পোষাক কিন্তু চোখ-মুখ খুশীতে জ্বলজ্বল করছে। দূর থেকেই দেখতে পেল গ্রামের মুখেই বাঁশের খুঁটিতে নতুন দেশের স্বাধীন পতাকা পতপত করে ওড়ছে। দেখেই ওদের মনপ্রাণ জুড়িয়ে এল। একজন অন্যজনের দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি ছড়িয়ে দেয়। বুকের ভেতর চেপে থাকা কষ্ট আর ক্ষত কিছুটা হলেও লাগব হয়ে আসে। আসতে আসতে গ্রাম বাংলার বিধ্বস্ত চেহারা দেখতে দেখতে বুকের পাঁজর যেন ক্ষতবিক্ষত হয়ে আসছিল। এই পতপত করে ওড়তে থাকা পতাকাটাই যেন সব দুঃখ-কষ্ট ভুলিয়ে দিলো। কিন্তু গ্রামের বুকে পা রেখেই দু\'জন নিঃশব্দ, নিঃস্তব্ধ ও নির্বিকার।নিরুপমা নিজের ভেতর অন্য এক প্রাণের উপস্থিতি টের পায়। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। কানে বারবার বেজে ওঠে পাকসেনার শেষ কথাটা- কাবিল মিয়া, মেয়েটাকে সসম্মানে বাড়িতে ছেড়ে এসো। কাবিল মিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।জোরে ধমক দিয়ে পাকসেনা বলে- যা বলছি তাই কর। বীজ ঢুকিয়ে দিয়েছি। আমাদের বীজ এখানে ছড়িয়ে পড়ুক। ওরা আমাদের রক্তের টানই টানবে।কিন্তু হুজুর!- কাবিল মিয়া বেশ নিরাশ হয়েই বলে।কোন কিন্তু নয়। যাও ওকে ওর বাড়িতে রেখে এসো!বিপর্যস্ত নিরুপমা শূন্য দৃষ্টিতে শূন্য স্থানে অপলক দৃষ্টিতে কষ্টের নিঃশ্বাস ফেলে। এখন বেঁচে থাকাটাই জীবনের প্রতিক্ষণের বোঝা। কিন্তু নিজেকে কোনভাবেই ধাতস্থ করতে পারছে না; চোখের সামনে এমন শত শত ধর্ষিতা নারীর ক্ষত-বিক্ষত জীবন্মৃত চেহারা বুকের ভেতর কাঁপন তুলে। নির্যাতনের মাত্রা দেখলে কোন সুস্থ মানুষই বেঁচে থাকার কথা নয়। আর বেশির ভাগ মানুষকেই বুলেট আর বেয়নেটের আঘাতে মরতে হচ্ছে। নিরুপমা জানে না কেন তাকে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। সে-তো কিংশুকের কোন ইনফরমেশনই দেয়নি। অত্যাচারের চরমসীমায়ও সে একদম চুপচাপ ছিল।পাকসেনার ধমকে কাবিল মিয়া নিরুপমাকে টেনে নিয়ে চলে আসে নিজের বাংলোয়। সারারাত নিজের কাছে রেখে ভোর বেলায় ওদের বাড়ির উঠানে ফেলে আসে।মায়ের আদরে-সোহাগে আর বাবার অসহায় দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে নিরুপমা সব ভুলতে চেষ্টা করে। কিংশুকের ভালোবাসার কথা ভেবে নিজেকে সামলে নেয়। কিন্তু যখনই নিজের ভেতর অন্য একটি প্রাণের টের পায় তখন নিরুপায় নিরুপমা নিজেকে আর সামলাতে পারেনি।লাশটা এখনও গাছে ঝুলছে। হাবিব ও কিংশুক ভীতসন্ত্রস্ত পায়ে কাছে এগিয়ে আসে। মাটিতে হাঁটু গেঁড়ে বসে কিংশুক কান্নায় ভেঙে পড়ে। হাবিব কিংশুকের কাঁধে হাত রেখে বুক টান টান করে বলে- কোন্ শুয়োরের বাচ্চা এমন সর্বনাশ করল।কানাঘুষায় সব কারণই জানতে পারল নিরুপমার এমন পরিস্থিতির জন্য। হাবিব কিংশুকের বন্দুকটা ওর হাতে তুলে দিয়ে বলে- চল, আমার সাথে চল!হাবিব কিংশুককে টেনে নিয়ে চলে। নির্বাক-নিঃস্তব্ধ কিংশুক হাবিবের টানে টানে হেঁটে চলে। আর চোখ জোড়ায় যেন দৃষ্টি নেই বললেই চলে। হাবিবদের বাড়ির উঠানের সামনে বসেই কাবিল মিয়ার মুখোমুখি হয় ওরা।কাবিল মিয়া দৌঁড়ে এগিয়ে আসে। আর কাঁদু কাঁদু হয়ে বলে- আমার আব্বাজান! আব্বাজান আমার! ফিরে এসেছো!সাবধান! আমাকে ছোঁবে না তুমি।– এই বলেই হাবিব কয়েক কদম পিছিয়ে আসে। কাবিল মিয়া অবাক হয়ে তাকায় এবং বলে- কেন আব্বাজান!কথার কোন জবাব না দিয়েই হাবিব কাবিল মিয়ার এক হাত টেনে ধরে টেনে-হেঁছড়ে নিয়ে চলে।আব্বাজান! তোমার কী হয়েছে?- কাবিল মিয়ার চোখ জোড়া প্রায় কপালে ওঠার উপক্রম। কিংশুকও ভাষাহীন এবং চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।হাবিব ডাক দেয়- কিংশুক দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আমার সাথে আয়।কিংশুক কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে- উনি তোর বাবা হন।কাবিল মিয়া কাতর কন্ঠে বলেন- হ্যাঁ আব্বাজান, আমি তোমার বাবা হই!কোন কথা না বলে হাবিব ওর আব্বাকে টেনে হেঁছড়ে নিয়ে চলে। তারপর চলে আসে ঝুলন্ত নিরুপমার লাশের কাছে। লাশটা দেখিয়ে হাবিব বলে- ওকে চিনতে পারছো আব্বাজান!একবার তাকিয়েই কাবিল মিয়া দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে আসে এবং একদলা থুথু ফেলে বলে- ওটাতো নষ্টা মেয়েছেলে।হাবিব নিজেকে আর সামলাতে পারলো না- ওটা নষ্ট মেয়ে! না? ওটা নষ্ট মেয়ে! কে নষ্ট করেছে?- বলেই এক ধাক্কায় কাবিল মিয়াকে মাটিতে ফেলে দিল। তারপর দীপ্ত কন্ঠে কিংশুককে বলল- নে... এবার গুলি চালা!কিংশুক অবাক হতেও অবাক হচ্ছে। নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। তাই বলে নিজের বাবাকে মারবি!হাবিবের স্পষ্ট উচ্চারণ- শরীরের কোন অংশ পঁচে গেলে কেটে ফেলাই উচিত। নয়তো সারা শরীরে পচন ধরবে। আর সে আমার আব্বা হতেই পারে না। আমি স্বীকার করি না। নে... গুলি চালা এবার!কিংশুকের দৃষ্টি অবনত হয়ে আসে। কিন্তু হাবিব নিঃস্তব্ধতা ভেঙে ট্রিগারে আঙুল চাপে... কাবিল মিয়া মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।তাই বলে তোর আব্বাকে মেরে ফেললি!সে আমার আব্বা হবার যোগ্য নয়। আর ওদের বাঁচিয়ে রাখলে দেশটা শেষ করে ফেলবে। আগাছা অংকুরেই বিনাশ করা ভালো।কিংশুক হাবিবকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে।*ঈশ্বর বলেন, অদৃশ্য শক্তিই বলেন আর কিংবা প্রকৃতির নিয়ম- সময়ের স্রোত বেয়ে হেঁটে চলতে চলতে মানুষের কষ্টগুলো হালকা হ\'তে থাকে। নিরুপমাকে হারানোর বেদনা ভুলতে কিংশুকের দীর্ঘ সময় লেগেছে।বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসেও নিরুপমার স্মৃতি আঁকড়ে বেড়াচ্ছে কিংশুক। সেই হাসিমাখা, লাবণ্যভরা আর মুগ্ধ ভালোবাসা ঘেরা চোখ জোড়া এখনও ক্ষণে ক্ষণে মনের ভেতর ভেসে ওঠে। জীবনের প্রথম চুম্বনের আবেশভরা স্মৃতিটুকু এখনও তাড়া করে, আবেগাপ্লুত করে। একটা মোহাচ্ছন্নতায় আটকে আছে সে। সেন্ট্রাল লাইব্রেরির কোণে গাছতলায় বসে আপন মনে সিগারেট টানছিল কিংশুক; আচমকা একটা কন্ঠস্বর ওর দৃষ্টি কেড়ে নিল- তাকিয়েই হতবাক, বাকহীন, অপলক তাকিয়ে আছে সে; একি সত্যি দেখছি!- স্বগোক্তি করে কিংশুক নিজের গায়ে চিমটি কাটে- সত্যিই তো!এক দৌঁড়ে এগিয়ে গিয়ে মেয়েটার পথ আগলে দাঁড়ায় কিংশুক- নিরুপমা! তুমি এখানে?মেয়েটি অবাক হয়ে শুধু তাকিয়েই থাকে। কোন কথা বলে না।কিংশুক আবারও বলে- নিরুপমা! তুমি এখানে?মেয়েটি এবার কথা বলে- আমি অনুসূয়া।নিরুপমা... নিরুপমা... নিরুপমা... কিংশুক মনে মনে বারবার আওড়ায়। আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। ও হচ্ছে অনসূয়া।– সাথের মেয়েটি ভুল ভাঙাতে বলে। আর কোন কথা না বলে ওরা চলে যায়।কিংশুক ঠায় দাঁড়িয়ে। আর মনে মনে ভাবে- এটা কী করে সম্ভব! দেখতে হুবহু এক! নাক, চোখ, মুখ, চুল, গায়ের রঙ, চাহনি এমনকি কন্ঠস্বর সবইতো এক। আর নিরুপমাতো নেই। তাহলে এখানে এলো কী করে! হয়তো আমারই ভুল। অনেকেই বলে- ঈশ্বর নাকি প্রতিটি মানুষ এক জোড়া করে পাঠিয়েছে; জোড়াটিকে দেখতে প্রায় এক। হবে হয়তো।– ভাবতে ভাবতে আরেকটা সিগারেট ধরায় কিংশুক। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে একটা ঘোরের মধ্যেই আটকে থাকে সে। সিগারেটের পর সিগারেট শেষ করে কিন্তু ঘোরটা এখনও কাটছে না। কখন দুপুর গড়িয়ে গেছে টেরই পায়নি। ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে কিন্তু এখান থেকে একদম উঠতে মন চাচ্ছে না। বাদামওয়ালাকে ডেকে এক প্যাকেট বাদাম কিনে নিলো। বাদাম টিপে খাচ্ছে আর সিগারেটে দম বসাচ্ছে। মেয়েটি নিরুপমা নয়, অনুসূয়া... !- ভাবছে আর সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে।ক্লাস শেষে বান্ধবীদের সঙ্গেই ঢাকসু ক্যাফেটেরিয়াতেই দুপুরের খাবার খেয়ে সোজা লাইব্রেরিতে ঢুকেছিল অনুসূয়া। লাইব্রেরি থেকে বের হতে হতে প্রায় চারটা বেজে গেল। লাইব্রেরির বারান্দা থেকে নেমে বারান্দার সামনে দিয়েই হেঁটে চলছিল অনুসূয়া। বাদাম ফাটিয়ে যেই-না ফু দিতে যাবে অমনি কিংশুকের দৃষ্টি অনুসূয়ার দৃষ্টিতে আটকে গেল। কিংশুক উঠে দাঁড়িয়ে বলল- এতক্ষণে ফিরলেন?অনুসূয়া অবাক হয়ে বলে- মানে!কিংশুক বুঝতে পারে যে, সে চিনতে পারেনি। তাই বলে!- মনে মনে উচ্চারণ করে বলে- আমাকে চিনতে পারেননি?অনুসূয়া বেশ শান্তভাবেই বলল- না মানে, আপনাকে ঠিক চিনতে পারিনি।আমি সেই... সকালে আপনাকে নিরুপমা ভেবে ভুল করেছিলাম।ও... হ্যাঁ মনে পড়েছে।– বলেই চলে যেতে চাচ্ছিল অনুসূয়া।যদি কিছু মনে না করেন, আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চাই।অনুসূয়া দাঁড়ায় না। হাঁটতে হাঁটতেই বলে- আপনার সাথেতো আমার কোন পরিচয় নেই।আমি জানি। আপনার কোন কথা নেই। কিন্তু যদি কিছু মনে না করেন...।– কিংশুক অনুরোধ করে বলে।অনুসূয়া হাঁটতে থাকে।কিংশুক আর কোন কথা না-বাড়িয়ে বলে- ঠিক আছে। আমার মনে হয় আপনি এখন একটু ব্যস্ত আছেন। পরবর্তীতে কথা হবে। আমি কিংশুক চৌধুরী। এখানেই আপনার জন্যে অপেক্ষা করবো। আর কোন কথা বাড়ায় না সে। অনুসূয়া কোন জবাব না দিয়ে চুপচাপ হেঁটে চলে যায়।*রুমে ফিরে আসার পর থেকেই অনুসূয়ার মনটা অস্বস্তিতে আঁকুপাঁকু করতে লাগলো। ছেলেটির সাথে এমন ব্যবহার করা উচিত হয়নি। শোনা উচিত ছিল... কী বলতে চাচ্ছিল। ঘুরেফিরে বারবার একই কথা মনের ভেতর উঁকি দিচ্ছে। একটা অস্বস্তির ব্যামো নিয়েই সারাটা বিকেল রুমের ভেতরই কাটিয়ে দিল। সন্ধ্যার পর লেখাপড়াতেও মন বসাতে পারেনি। কোনকিছুতেই তার মন বসছে না। এমনটা কেন হচ্ছে এর কোন কারণও বের করতে পারছে না। শুধু একটা কথাই কানে বাজছে- ‰আমি এখানেই আপনার জন্যে অপেক্ষা করবো।\' নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে- কেন অপেক্ষা করবে? চেনা নেই, জানা নেই একজন মানুষের সাথে কী এমন কথা থাকতে পারে? যাই হোক সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবু এভাবে উপেক্ষা করে চলে আসাটা উচিত হয়নি। কী বলতে চায় শোনা উচিত ছিল। তাছাড়া হাবভাব দেখে খারাপ কিছুতো মনে হয়নি। যাক যা হবার হয়েছে। নিজেকে নিজে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করে অনুসূয়া। আবার মনের মধ্যে উঁকি দেয় জীবনের মাঝে গেঁথে থাকা কষ্টগুলো; পুরুষদের বিশ্বাস করাটাই দুষ্কর। ওরা মেয়েদের শরীরটাকে সবচেয়ে বেশি চায়। তবে সব পুরুষ এক না-ও হতে পারে। কিন্তু কাকে বিশ্বাস করবো! নিজের জামাইবাবুর কথা মনে হতেই সকল তিক্ততা মুহূর্তেই ঝেঁকে বসলো। মোটামুটি সবাই জানে যে, বিশ্ববিদ্যালয় হলগুলোতে খাবারের মান খুবই নিম্ন। তাছাড়া একই খাবার খেতে খেতে মুখের রুচিবোধ তিক্ততায় পূর্ণ হয়ে আসে। তাই মুখের রুচির পরিবর্তন করতেই অনুসূয়া তার দিদির বাসায় প্রায়ই গিয়ে হাজির হয়। অবশ্য দিদি এবং জামাই বাবুও খুব করে পীড়াপীড়ি করে। যার জন্য একটু বেশিই যাওয়া হতো। মাস তিনেক পূর্বের ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয় তিন দিনের বন্ধ থাকাতে দিদির বাসায় চলে আসে অনুসূয়া। দিদির বাসাতে ওর সময় সবসময়ই খুব ভালো কাটে। একদিকে দিদি যেমন আদর করে ও ভালোবাসে তেমনি জামাইবাবুও বেশ আদর ও স্নেহ করেন। দিদির নতুন সংসার। সবকিছু মিলিয়ে বেশ ভালোই চলছে ওদের। জামাইবাবু ভালো চাকুরী করেন। এবারের প্রথম দিনটা যথারীতি বেশ ভালোই কাটে। কিন্তু দ্বিতীয় দিনটা হয়ে যায় জীবনের এক কালো অধ্যায়; দিদি প্রতিবেশি এক আপুর সাথে শপিং-এ বেরিয়ে যায়। অবশ্য অনুসূয়াকেও যেতে বলেছিল। সামনের সপ্তাহে পরীক্ষা আছে বিধায় অনুসূয়া বাইরে যায়নি। এদিকে জামাইবাবুও সন্ধ্যার আগে এসেই হাজির। কলিং বেল টিপতেই অনুসূয়া এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়। তাড়াহুড়ার মধ্যে ওড়নাটা নিতে একেবারে ভুলেই গিয়েছিল। জামাইবাবুর দৃষ্টিখানা উন্নত বুকখান এড়ায়নি। অনুসূয়া একটু জড়োসড়ো হয়ে নিজেকে গুঁটিয়ে নেয়। জামাইবাবু জানতে পারেন যে, অনুসূয়ার দিদি শপিং-এ গিয়েছে। ধীরে ধীরে জামাইবাবুর আবদার একের পর এক বাড়তে থাকে; এক গ্লাস জল দাও, এক কাপ চা করে দাও প্লিজ!- তারপর কম্পিত কন্ঠে জামাইবাবু বলেন- অনুসূয়া, তুমি কী খুব ব্যস্ত?ভদ্রতা দেখিয়ে প্রতিদিনকার মতো সে বলে- না জামাইবাবু, আপনার আর কিছু লাগবে?অচেনা কন্ঠস্বরে জামাইবাবু বলেন- আজ কাজের খুব বেশি প্রেসার গিয়েছে। মাথাটা ভীষণ ব্যথা করছে। চুলগুলো একটু টেনে দিতে যদি ভালো হতো।অনুসূয়া জামাইবাবুর কন্ঠস্বরের মর্মার্থ বুঝতে পেরেও তেমন পাত্তা দেয়নি। কারণ সে জানে ওর জামাইবাবু নিখাদ একজন ভদ্রলোক। তাই এগিয়ে গিয়ে মাথার চুলে বিনুনি কাটতে থাকে। সেকেণ্ড যায়... মিনিট যায়... পনের মিনিটও পেরোয়নি অনুসূয়াকে জোর করে বুকের মধ্যে টেনে নেন।অনুসূয়া কান্না করতে করতে জামাইবাবুর পায়ে লুটিয়ে পড়ে। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। নিরুপায় হরিণীর মতো বাঘের থাবায় আটকে গেল। সব হারিয়ে অনুসূয়া একেবারে স্তব্ধ, নির্বাক ও পর্যুদস্ত।অনুসূয়াকে আদর করতে করতে জামাইবাবু বলেন- তুমি এত ভেঙে পড়ো না। এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। তাছাড়া তুমি আমার শ্যালিকা, এটুকু অধিকার তোমার ওপর আমার আছে। তুমি বিশ্বাস কর, এই তোমাকে ছুঁয়ে বলছি; এ ব্যাপারে কেউ কোনদিন কিচ্ছু জানতে পারবে না। বেশ অবাক হয়েই জামাইবাবুর দিকে তাকায় অনুসূয়া এবং বেশ আশ্চর্য হয়েই ভাবে- অপরাধ করে আবার প্রচ্ছন্ন হুমকি দিচ্ছে। মনটা অবাধ্য হয়ে ওঠতে চাচ্ছে কিন্তু দিদির কথা ভেবে ছলছল চোখজোড়া অবনত করে নেয়। হাঁটুতে থুঁতনি গেঁড়ে অনুসূয়া মেঝেতে বসে রইল। ভেবে ভেবে কোন কূল-কিনারা পাচ্ছে না।শোন অনুসূয়া, একদম স্বাভাবিক হয়ে যাও। তোমার দিদি যেন বিন্দুমাত্রও টের না পায়। টের পেলে তোমারই ক্ষতি হবে। তোমার ভালোর জন্যেই বলছি। একেবারে স্বাভাবিক হয়ে যাও। তোমার দিদি যে কোন সময় চলে আসতে পারে।– এই বলে জামাইবাবু তোয়ালে নিয়ে সরাসরি বাথরুমে চলে গেলেন।নানান চিন্তা করে, বিশেষ করে দিদির কথা ভেবে অনুসূয়া নিজের মনটাকে শক্ত করে নেয়। হাত-মুখ ভালো করে ধুয়ে চুপচাপ পড়ার টেবিলে চলে আসে। সেই যে আসা আর এখন পর্যন্ত যাওয়া হয়নি দিদির বাসায়। প্রায় একমাস হ\'তে চলল।আজ কেন যেন কিংশুকের কথাগুলো কানের ভেতর রিনিঝিনি সুরে বারবার বেজে ওঠছে। পরক্ষণই আবার জামাইবাবুর চেহারা ভেসে ওঠে। একটা দ্বিধাদ্বন্ধের ভেতর দোল খাচ্ছে অনুসূয়া। কিন্তু কিংশুকের কথা বলা, চোখের দৃষ্টি কোথাও কোনরকম বিচ্যুতি দেখতে পায়নি। বিশেষ করে কেন যেন ওকে দেখতে অথবা এগিয়ে গিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। অপেক্ষায় থাকবে বললো। অতঃপর নিজেই নিজের মনটাকে শাসন করে বলে- না, কোন পুরুষকেই আর বিশ্বাস করা যাবে না।– ভাবতে ভাবতেই ঘুমের রাজ্যে ডুবে যায় অনুসূয়া।*সকালে ঘুম থেকে উঠেই স্নানাহার সেরে ফেলল অনুসূয়া। ক্লাস সেই এগারোটায় অথচ অজানা এক মোহে এবং টানে নয়টা নাগাদ রুম থেকে বেরিয়ে আসে সে। হাকিমচত্বর পেরিয়ে একটু এগোতেই লাইব্রেরির কোণে দৃষ্টি চলে গেল। কিংশুক ঠিকই চুপচাপ বসে আছে। কাছে এগিয়ে আসতেই কিংশুক হাসি মুখে উঠে দাঁড়ায় এবং বলে- কেমন আছেন?ভালো। আপনি?হ্যাঁ ঈশ্বর ভালো রেখেছেন।কুশলাদি বিনিময়, পরিচিত হওয়া... তারপর কিংশুক বলল- আপনার যদি তাড়া না থাকে তবে কিছুক্ষণ বসে কথা বলতে পারি। কী বলেন?- বলেই কিংশুক স্নিগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে।কোন কিছু না বলেই অনুসূয়া বারান্দার এককোণে বসলো। একটু দূরত্ব বজায় রেখে কিংশুকও বসল। কথায় কথায় জানা হলো দু\'জন একই বর্ষের ছাত্রছাত্রী যদিও ডিপার্টমেন্ট আলাদা।নিরুপমার কথা জানার পর অনুসূয়া কিংশুকের প্রতি আরও একটু নমনীয় এবং বন্ধুবৎসল হয়ে ওঠে। তারপর ঘন্টা, দিন, মাস পেরিয়েই ওরা টের পায় একজন অন্যজনকে অনুভব করে। একদিন দেখা না হলেই উভয়ই উৎকন্ঠায় থাকে। লাইব্রেরির সামনে বসে প্রায়ই গল্প করে। মলচত্বরে বসে দু\'জন একাকি আড্ডা দেয়। পাবলিক লাইব্রেরির চত্বরে প্রায়ই চলে দিনভর পড়াশুনা আর আড্ডা। নাটকপাড়া বেইলি রোডে নাটক দেখতে যায়। আর প্রায়ই চলে টি, এস, সি-এর ভেতরও ম্যারাথন আড্ডা চলে। কিংশুক যেন নতুন জীবন ফিরে পায়। আর অনুসূয়াও ভুলতে থাকে কালো অধ্যায়ের দুঃস্বপ্নটা।কিন্তু সুনীল আকাশ বেশিক্ষণ সুনীল থাকে না। কখনওবা হালকা মেঘে আবার কখনও কালো মেঘে ছেয়ে যায়। অনুসূয়ার জন্মদিন উপলক্ষ্যে ওরা দু\'জন সেই সকাল থেকে নানান জায়গায় ঘোরাঘুরি করে। শেষে ‰নীরব হোটেল\' থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে বের হয়। রিক্সা ডেকে উঠে বসেই কিংশুক রিক্সার হুডটা টেনে দিয়ে বলে- রোদটা ভীষণ কড়া লাগছে। এখন দু\'জন খুবই অন্তরঙ্গ হয়ে চাপাচাপি করে বসে আছে। কিংশুকের ভালোবাসার হাত দিয়ে অনুসূয়াকে একটু আগলে ধরে। অনুসূয়া অস্বস্তিবোধ করলেও মুখে কিছু বলেনি। কিছুদূর এগোতেই কিংশুক ফিসফিসিয়ে বলে- অনুসূয়া!- কন্ঠটা একটু কম্পিত মনে হচ্ছে।অনুসূয়া কিংশুকের চোখে চোখ রাখে এবং জানতে চায়- বলো, কী বলবে।তোমার জন্মদিনে তোমাকে একটা স্পেশাল গিফট দিতে চাই।অনুসূয়া মুচকি হেসে চুপচাপ।নীরবতায় সম্মতি মেনে কিংশুক বলে- তুমি চোখ জোড়া একটু বন্ধ করো, প্লিজ!কোনকিছু না বলেই অনুসূয়া চোখ জোড়া বন্ধ করে একগাল হাসি ছড়িয়ে দেয়। অনুসূয়ার দিকে তাকিয়েই কিংশুক আবেগপ্রবণ হয়ে যায়; দেখতে ঠিক নিরুপমার মতোই লাগছে। আচমকা ফিরে যায় সেই ফেলে আসা সময়ের সন্ধিক্ষণে। অনুসূয়ার গ্রীবায় হাত রেখে একখান উষ্ণচুমু বসিয়ে দেয়।অনুসূয়া চমকভরা দৃষ্টিতে তাকালো। যেন আকাশ থেকে ছিটকে পড়লো সে। অভিমানী এবং রাগভরা চোখ জোড়া কিন্তু কিছু না বলে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।তুমি রাগ করেছো অনুসূয়া?কোন উত্তর নেই।কিংশুক অনুসূয়াকে জড়িয়ে ধরা হাতটা চুপচাপ সরিয়ে নিয়ে আবারও জিজ্ঞ্যেস করে- তুমি রাগ করেছো?কোন জবাব নেই। আর অনুসূয়া মনে মনে ভাবে- পুরুষরা এমনই হয়। এক পা, দু\'পা, তিন পা তারপর এগিয়ে আসে শরীরের দিকে।হলের সামনে রিক্সাটা থামতেই অনুসূয়া কোন কথা না বলেই চলে যাচ্ছিল। কিংশুক পথ আগলে দাঁড়ায় এবং আবারও বলে- স্যরি অনুসূয়া!অনুসূয়া বেশ রাগতঃ কন্ঠেই বলে- তোমরা সব পুরুষই এক। আমাকে তুমি ভুলে যেও। স্যরি অনুসূয়া! আর কখনও এমন হবে না। তাছাড়া আমি তোমাকে ভালোবাসি।বললামতো, তুমি আমাকে ভুলে যেও।এটা কখনও সম্ভব নয়।সবই সম্ভব। মনে করো এটা একটা স্বপ্ন ছিল।– আর কোন কথা না বলে অনুসূয়া চলে যায় হলের ভেতর। হঠাৎ যেন সময় থমকে গেল, কিংশুক ঠায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল খেয়াল নেই। তারপর বিষন্ন মনে হাকিম চত্বরে এসে বসে। মনের ভেতর কষ্টগুলো এখনও তোলপাড় করে চলেছে; সেই কখন থেকে নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করছে। কোনমতেই নিজেকে প্রবোধ মানাতে পারছে না। বারবার প্রতিবার মনের ভেতর স্বগোক্তি- বিশ্বাস করো অনুসূয়া, আমার মনের ভেতর কোন পাপ ছিল না। আকাশ, বাতাস আর আকাশের সব পাখিকে আমি চিৎকার করে জানিয়ে রাখছি- আমার মনে কোন পাপ ছিল না।*পরদিন। পড়ন্ত বিকেল। রোকেয়া হলের গেইটের পশ্চিম পাশে ডালপালাহীন মৃত গাছের গুড়ি ঘেঁষে কিংশুক চুপটি করে বসে আছে। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে আবার কোথাও যেন তাকাচ্ছে না। মনে মনে শুধু একজনকে খুঁজছে। না, অনুসূয়া আসেইনি। ঘন্টা, দিন, সপ্তাহ পেরিয়ে গেল অনুসূয়ার দেখা নেই। দিনকে দিন কিংশুক কেমন যেন বেসামাল হয়ে যাচ্ছে। এত মন্দ হাওয়া মনের ভেতর এর আগে আর কখনও বয়ে যায়নি; মুক্তিযুদ্ধের সময়ও অনেক কঠিন সময় পেরিয়ে এসেছে, পেরিয়ে এসেছে নিরুপমার মৃতদেহ পড়ে থাকার দুঃসহ সময়। কিন্তু এখন যেন সবকিছুকেই ছাপিয়ে যাচ্ছে। মনে মনে ভাবে আবার একবার একটা খবর পাঠিয়ে দেখা যাক। নিজের পাথরসম দেহটাকে টেনে গেইটের সামনে এসে দাঁড়ায়- অনেক মেয়েই সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। কিন্তু কাউকে কিছু বলতে সাহস পাচ্ছে না।হঠাৎ চোখ পড়ে- একটা মেয়ে সাজগোজহীন। অতি সাধারণ দেখতে এবং তার মধ্যে কোন ব্যস্ততা নেই। কিংশুক এগিয়ে গিয়ে নম্রভাবে বলে- এক্সকিউজ মি!মেয়েটি শব্দহীন ফিরে তাকায়। দৃষ্টিজোড়া জিজ্ঞাসা।কিংশুক বলে- আপনি কি ব্যস্ত আছেন?কেন বলুনতো?আমার এক বান্ধবীকে একটু ডাকার দরকার ছিল।রুম নম্বর এবং নামটা বলুন।রুম নম্বর এবং নামটা বলতেই মেয়েটা বলল- ঠিক আছে, আপনি অপেক্ষা করুন। আমি খবরটা দিয়ে আসছি।অশেষ ধন্যবাদ।– বলেই কিংশুক উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষায় থাকে। আর মনে মনে ভাবে- এই শেষ আর কখনও না!- তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আকাশের দিকে দুঃখে ভারাক্রান্ত দৃষ্টিটুকু মেলে দেয়।মিনিট দশেকের মধ্যেই মেয়েটি ফিরে এল। একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল- দাদা, মনে কিছু করবেন না।– কিংশুকের মায়াবী ম্লান চেহারাটা দেখে খুব মায়া হয় এবং মনে মনে ভাবে সত্যি কথাটাই বলা দরকার। কিংশুক বিস্ময়ভরা চোখে তাকায়।উনি রুমে আছেন। কিন্তু বলে দিয়েছেন যে, উনি রুমে নেই বলতে। এরপর মেয়েটি ইচ্ছে করেই বানিয়ে বানিয়ে আরও কিছু কথা বলল। অনুসূয়ার রুক্ষ ব্যবহারটা ওর ভালো লাগেনি। তাছাড়া কিংশুকের দিকে তাকাতেই ওর ভেতর যেন কেমন একটা মায়া মায়া হাওয়া বয়ে গেল। তারপর টুকিটাকি কথাবার্তার ফাঁকে জানা গেল- মেয়েটির নাম নীলাঞ্জনা এবং এক বৎসর জুনিয়র।তাহলে আপনাকে, কিংশুক\'দা বলেই ডাকতে পারি নাকি?হ্যাঁ অবশ্যই। আজ তাহলে আসি। ভালো থাকবেন।– এই বলে ঝড়ো হাওয়ায় বিধ্বস্ত পাখির মতো শরীরটাকে টেনে চললো কিংশুক। মনে হয় আর দেখা করবে না; প্রায় এক মাস হয়ে গেল! ভাবতে ভাবতেই লাইব্রেরির বারান্দার কোণে এসে বসল। যেখানে বসে অনুসূয়ার সাথে প্রথম কথা হয়েছিল। প্রতিদিনই এখানে বসে থেকে দৃষ্টি মেলে অপেক্ষায় ছিল অনুসূয়াকে দেখতে পাবার আশায়। কিন্তু এ পর্যন্ত আর দেখা পায়নি।অনুসূয়া এখন আর এ পথে যাওয়া-আসা করে না। পথ পাল্টে কলাভবনের সন্মুখ গেইট দিয়ে চলাচল করে। তাছাড়া দূর থেকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে অনুসূয়া চলাচল করে। ডিপার্টমেন্টেও গিয়ে ওর খোঁজ পায়নি কিংশুক।*নীলাঞ্জনা প্রায় সপ্তাহ খানেক ধরেই লক্ষ্য করছে- কিংশুক\'দা একই জায়গায় প্রয় সারাদিনই বসে থাকে এবং একা একা। সদ্য পরিচিত তাই এতদিন কাছে এগিয়ে গিয়ে কথা বলা হয়ে ওঠেনি। আজ ফিরতি পথে লাইব্রেরির কাজ শেষে বারান্দা ধরে হেঁটে এগিয়ে চলে। কাছাকাছি এসে নীলাঞ্জনা বলে- নমস্কার কিংশুক\'দা, কেমন আছেন?ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আসতে কিংশুকের বেশ কিছুটা সময় লাগে। ঘোর লাগা চোখে একটু অবাক করা দৃষ্টি নিয়ে সে তাকায়। নীলাঞ্জনা বুঝতে পেরে বলে- আমাকে চিনতে পারছেন না? আমাদের হল গেইটে কথা হয়েছিল।ও হ্যাঁ, স্যরি... স্যরি... নীলাঞ্জনা। আপনি কেমন আছেন?হ্যাঁ, ভালো আছি। মনে কিছু করবেন না, একটা কথা বলবো?হ্যাঁ, নিশ্চয়ই বলুন।তার আগে বলুন- আপনি আমাকে ‰আপনি\' ‰আপনি\' বলবেন না। আমি আপনার জুনিয়র। আমাকে তুমি করেই বলতে পারেন দাদা।ঠিক আছে, হয়ে যাবে। দাঁড়িয়ে কেন? তাড়া না থাকলে বসতে পারো।নীলাঞ্জনা কোন কথা না বলেই পাশাপাশি হয়ে বসল। কাছ দিয়েই চা-ওয়ালা পিচ্চিটা যাচ্ছিল। কিংশুক ডাক দিয়েই আবার নীলাঞ্জনাকে বলল- চা চলবে তো?নীলাঞ্জনা ভদ্রতা করেই বলল- আপনি যদি খান তবে খেতে পারি।পিচ্চিটা কাছে আসতেই কিংশুক বলল- লাল চা হবে?জ্বী হবে।দু\'কাপ দে।দু\'কাপ চা নিয়েই পিচ্চিকে বিদায় করলো। চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই নীলাঞ্জনা কিংশুকের চোখে চোখ রাখে এবং বলে- আপনাকে সেই সকাল থেকেই এখানে বসে থাকতে দেখলাম।কিংশুক অবাক এবং নিরুত্তর। চায়ের কাপে চুমুক দিতেও ভুলে গেছে। স্যরি, রিয়েলি স্যরি, আপনাকে একান্ত ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে ফেললাম।ইটস ওকে নীলাঞ্জনা। তারপর কষ্টের একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কিংশুক বলে- তুমি ঠিকই বলেছো। এখানে বসে থাকতে আমার খুব ভালো লাগে।নীলাঞ্জনা ইচ্ছে করেই প্রসঙ্গ পাল্টায় এবং বলে- আজ ক্লাসে যাননি?না, ভালো লাগছিল না। তাই এখানে বসেই কাটিয়ে দিলাম।– বলেই এক পলক নীলাঞ্জনার দিকে তাকায়- গায়ের রঙটা ঘষামাজা, কিন্তু দেখতে অপূর্ব। তাছাড়া কোনরকম সাজগোজ পর্যন্ত নেই; ঠোঁটে কোন লিপস্টিকের রঙ নেই। ওর সবকিছুতেই যেন প্রকৃতির ছোঁয়া। আর চুলগুলোতে যেন শান্ত মেঘের ছড়াছড়ি। নীলাঞ্জনা দৃষ্টি ফেরানোর আগেই কিংশুক দৃষ্টি সরিয়ে চাপের কাপে চুমুক বসায়।কিংশুকের জন্যও নীলাঞ্জনার মনের আকাশটা কষ্টে ছেয়ে যায়। চোখের দিকে তাকালেই কষ্টগুলো আন্দাজ করা যায়। যেখানে ডুবে থাকা সন্ধ্যাতারা ঝিকমিকিয়ে ওঠে। ক\'জনার ভাগ্যে জোটে এমন ভালোবাসা। অথচ অবজ্ঞার স্রোতে নির্জীব হয়ে আছে।– ভাবতে ভাবতেই নীলাঞ্জনা একটু আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে- দাদা, সন্ধ্যা হয়ে এলো। আমি এখন উঠতে চাচ্ছি।হ্যাঁ, অবশ্যই। তোমার সাথে কথা বলে ভালোই লাগলো নীলাঞ্জনা। এসো... ভালো থেকো। আসি... আপনিও ভালো থাকবেন।কিংশুক অবাকভরা দৃষ্টি নিয়ে নীলাঞ্জনার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকে।*নদী পথের গতি যেমন থেমে থাকে না তেমনি মানুষের জীবনও কখনও থেমে থাকে না। সময় আপন গতিতে এগিয়ে চলে এবং সময়ের সাথে সাথে প্রতি বসন্তে মানুষের মন বদলায়। ক\'জন পুরুষ আর কাকজীবনে কাটায় বা কাটাতে পারে অথবা কাকজীবনে ডুবে থাকে। যেমন কিংশুক পারেনি। নিরুপমার ছায়ায় খোঁজে নিয়েছিল অনুসূয়াকে। আবার এখন অনুসূয়ার হারিয়ে যাওয়া প্রেক্ষাপটে নীলাঞ্জনা কিংশুকের মনের বাগানে গোলাপ হয়ে ফুটে ওঠল। এখন মনের বাগানটা আবারও বসন্তের ছোঁয়ায় যেন প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেছে। তবে মনের ভেতরকার আঁচড়গুলো মাঝে-মধ্যে খচখচ করে ওঠে। সব ছাপিয়ে কিংশুক এখন অন্য এক নতুন প্রাণবন্ত মানুষ।কেউ দেখে বুঝতে পারবে না যে, দিনের পর দিন, রাতের পর রাত প্রতিটিক্ষণ কষ্টের সমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়া একজন মানুষ সে। ওরা এখন টি,এস,সি-এর সবুজ চত্বরেই বেশি বসে। একসঙ্গে লাইব্রেরিতে যায়, নাটক দেখে আর নানান জায়গায় ঘোরাঘুরি। জীবন এখন স্বাভাবিক এবং সুন্দর। দু\'জন চুপচাপ বসে আছে। নীরবতা ভেঙে নীলাঞ্জনা বলে- আমার মনে হয় তুমি কিছু একটা নিয়ে খুব ভাবছো এবং চিন্তিত। তেমন কিছু না। আজ সন্ধ্যায় আমার মা-বাবা ঢাকায় আসছেন।নীলাঞ্জনা অবাক হয়ে তাকায়। না, তেমন কিছু না। দু\'জনকে ডাক্তার দেখাতে হবে।মেজর কোন সমস্যা? না, তেমন কিছু না। রেগুলার চেকআপ বলতে পারো। আমি ভাবছি।– এই বলে কিংশুক নীলাঞ্জনার দিকে তাকায়। নীলাঞ্জনাও চোখে চোখ রাখে।আমি ভাবছি মা-বাবার সাথে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দেবো। তোমার আপত্তি নেই তো?আমার কোন আপত্তি নেই। বরং খুব ভালো লাগবে।যাক, আমাকে শ্চিন্তামুক্ত করলে।তারপর দু\'জন চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে টিএসসি থেকে বেরিয়ে এলো।*বেশ প্রসন্নচিত্তেই কিংশুক মা-বাবাকে নিয়ে আসে রোকেয়া হলের পাশের যাত্রীছাউনির কাছে। মা-বাবাকে বসার জন্য কাগজ বিছিয়ে দেয়। কিংশুকের মা একটু ইতস্ততঃ করছিল বসতে গিয়ে। বুঝতে গিয়ে কিংশুক বলল- মা, ওই আশেপাশে তাকিয়ে দেখ। তোমার মতো আরও অনেকে এসেছেন এবং বসেছেন। লজ্জার কিছু নেই।বসতে বসতেই নীলাঞ্জনা এসে হাজির। আসার সাথে সাথে কিংশুক ওর মা-বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।মা আবারও জিজ্ঞ্যেস করলেন- তোমার পুরো নামটা কী মা।নীলাঞ্জনা ব্যানার্জী।নামটা শুনেই কিংশুকের মা-বাবা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে। নীলাঞ্জনা আড়ষ্টতা ভেঙে যেই-না কিংশুকের মা-বাবাকে প্রণাম করতে যাবে অমনি দু\'জনই একসঙ্গে বলে ওঠে- একি করছো মা! তুমি ব্রাহ্মণ ঘরের সন্তান। তোমাদের প্রণাম নেয়া আমাদের পাপ!কিংশুক স্বাভাবিক কন্ঠেই বলে- তা\'তে কী হয়েছে? ও তোমাদের সন্তানের মতো। নীলাঞ্জনা বলে- কিংশুক ঠিকই বলেছে।কিংশুকের বাবা বলেন- সন্তানের মতো ঠিক আছে। কিন্তু ব্রাহ্মণের প্রণাম নেয়া আমাদের পাপ। নরকে যেতে হবে।এবার কিংশুক বলে- বাবা, তুমি আমি সকলেই ব্রাহ্মণ হতে পারি। যার ব্রহ্ম জ্ঞান আছে সেই ব্রাহ্মণ। মা বলতে থাকেন- যতকিছুই বলিস, আমরা পাপী হতে পারবো না। নীলাঞ্জনা কিংশুকের কথায় তাল মিলিয়ে বলে- কিংশুক ঠিকই বলেছে কাকীমা।নাছোড়বান্দা মা-বাবার সাথে আর কথা বাড়ায় না কিংশুক; জানে ওদের সাথে তর্ক করে লাভ নেই। ওরা অন্ধ বিশ্বাসের বলি। এবার প্রসঙ্গ পাল্টে বলে- মা, কী খাবে বলো?মা আশ্চর্য এবং লাজুকভরা দৃষ্টিতে নীলাঞ্জনার দিকে তাকায়। নীলাঞ্জনা বুঝতে পেরে বলে- কাকীমা, এখানে লজ্জা করবেন না। অনেকের মা-বাবাই আসেন, বসেন, খান। তারপর কিংশুকের দিকে তাকিয়ে বলে- এক কাজ করো, চারটা আইসক্রীম নিয়ে এসো।কোন কথা না-বলেই কিংশুক চলে যায় আইসক্রীম আনতে। এবং মুহূর্তেই ফিরে আসে। হাতে চারটি আইসক্রীম।ছেলে-মেয়েদের সাথে বেশ আনন্দের সময়ই কাটালেন। এখানকার প্রাণবন্ত পরিবেশ দেখে উনারা সত্যিই আপ্লুত। যাবার সময় মা বলে গেলেন- মা নীলাঞ্জনা, ভালো থেকো।কিংশুক একটা অটো ডেকেই মা-বাবাকে নিয়ে চেপে বসলো। নীলাঞ্জনা মন খারাপের হাওয়ায় ভেসে বিদায় নিয়ে হলের ভেতর পা বাড়ায়। সন্ধ্যা নেমে আসে।*আহারে জীবন! বিরহ যার কপালে আঁকা কেমনে হবে তার প্রেমিকার সনে চিরদেখা। প্রেমিকার সনে হয় যে দেখা বসন্ত বাগানে আবার বাগান ভেঙে খান খান ঝড়ো হাওয়ার তাণ্ডবে। বাগানে বাগানে ঘোরাঘুরি, ওড়াউড়ি আবার হয় শুরু সুখের কলতান। আবার ভাঙে সকল সুর শরতের আকাশ হয় ম্লান। দু\'গালে হাত চেপে কিংশুক অন্যমনস্ক হয়ে লাইব্রেরির বারান্দার দক্ষিণ কোণেই বসা।বাসায় ফিরেই মা-বাবার এক কথা ওই মেয়েটা ব্রাহ্মণ। যা\'ই করো আর না-করো কিন্তু ওকে বিয়ে করা চলবে না। তাহলে চৌদ্দপুরুষ নরকে যাবে। কে বুঝাবে কাকে- মানুষ তো মানুষই! যার যে শিক্ষা তা\' সে পাবেই। তার অধিক বৈ কিছুই নয়। কিন্তু মা-বাবা নাছোড়বান্দা। কিংশুক নিরুপায় হরিণীর মতো ছটফট করে- এপাড়-ওপাড় কোনপাড়ই ছাড়তে পারছে না। ঝড়ো হাওয়ায় মাঝ আকাশে আটকে পড়া পাখির মতো ক্লান্ত। প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিয়ে তাতে আগুন লাগিয়েই বসালো লম্বা একখান টান। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বাতাসে বাতাসে মনের কষ্টগুলোকেও ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে কিংশুক। কিন্তু না! কিছুতেই মনটা শান্ত হচ্ছে না। নীলাঞ্জনা কখন এসে পাশে বসেছে তা\' একদমই টের পায়নি। অসহায় দৃষ্টি মেলে কিংশুক নীলাঞ্জনার দিকে তাকায়- চোখ জোড়ায় হাজারো রকমের প্রশ্ন।কী ব্যাপার কিংশুক! তোমাকে এত বিচলিত দেখাচ্ছে কেন?না, তেমন কিছু না। বসো প্লিজ!কিংশুকের গা ঘেষেই নীলাঞ্জনা বসে।বিস্তারিত শোনার পর নীলাঞ্জনা বেশ শান্ত হয়েই বলে- কিংশুক ওসব নিয়ে চিন্তা করো না। দেখবে, সময়ে সবই ঠিক হয়ে যাবে।একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কিংশুক বলে- আমার মনে হয় না। এত সহজে ব্যাপারটা মিটমাট হবে না। বললামতো ওসব নিয়ে কোন চিন্তা করো না। সময়ে সবই ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু হাওয়া বদলের সাথে সাথে কিংশুক নিজেকেও বদলে নেয়। ধীরে ধীরে ভালোবাসা নামক পৃথিবী থেকে সে নিজেকে ধীরে ধীরে লীন করে। সকল ভালোলাগাকে সে আর ভালোলাগায় বাঁধে না। সবার কাছেই নিজেকে অপ্রিয় করে তোলে ইচ্ছের বিরুদ্ধেই। বসন্ত বাগানের গোলাপে তাকায় না, কিংবা শরতের আকাশে ভেসে থাকা সাদা মেঘে দৃষ্টি মেলে দেয় না; সবকিছুই কিংশুকের কাছে এখন সাধারণ। অসাধারণের মাঝেও কিছু কিছু বিষয় অতি সাধারণের মতো আজীবন মনে গেঁথে থাকে। তেমনি নিরুপমা কিংবা অনুসূয়া অথবা নীলাঞ্জনা কিংশুকের মনের ভেতর কুঠুরীতে গেঁথে আছে- অথচ ওদের বসবাস যোজন যোজন আলোকবর্ষে।নীলাঞ্জনার চোখের জল একাকার হয়ে গেছে কিংশুকের দুঃখ কিংবা কষ্টের সাগরের নীল জলে। এই সাগরে প্রতিনিয়ত সাঁতরে বেড়ায় কিংশুক। জীবনের পরতে পরতে গেঁথে আছে ফেলে আসা প্রেমিকাদের ছন্দগুলো। এখনও কথা হয় নিরুপমার সাথে মনের ভেতর হেঁটে হেঁটে, অনুসূয়ার ছায়ায় ছায়ায় সে হাঁটে আর নীলাঞ্জনার কষ্টগুলোকে বুকের ভেতর লালন করে। এক বুকেই সকল প্রেমিকাদের ভালোবাসা সাজিয়ে রেখেছেন কিংশুক। আর সকল ফুলের বাগান হলো সূক্তিপ্রিয়া। ক্ষণে ক্ষণে প্রতিদিনে সকল ফুলের সুবাস ছড়িয়ে দেন সূক্তিপ্রিয়ার মন বাগান জুড়ে।ঘুমের ঘোরেই সূক্তিপ্রিয়া কিংশুক বাবুকে জড়িয়ে ধরেন। কিংশুক বাবু আরও কাছাকাছি হয়ে বুকের ভেতর টেনে নেন ভালোবাসার মানুষটিকে অথবা প্রেমিকাদের।শেষ রচনাকাল: ১১.০২.২০২২ – ১২.০২.২০২২, রায়ের বাজার, ঢাকা, বাংলাদেশ।
ইশ! এবারের শীতটা মনে হয় একটু বেশিই পড়েছে।– এই বলেই কিংশুক বাবু স্ত্রী সূক্তিপ্রিয়াকে আরও জড়িয়ে ধরতে যায়। হালকা এক মুখ-ঝামটা দিয়ে সূক্তিপ্রিয়া বলেন- আমি কী কম্বল? ফায়ার প্লেস, হ্যাঁ?তুমি আমার সব। ফায়ার প্লেস বলো, কম্বল বলো আর সম্বলই বলো- তুমিই আমার সব, বুঝলে!- কিংশুক বাবু সূক্তিপ্রিয়ার নরম তুলতুলে বুকের ভেতর হাত বাড়াতে যায়।
0 Comments