জেলার একেবারে প্রান্তে, যেখানে কাঁচা রাস্তা পেরিয়ে ধানখেতের সীমানা মিশে গেছে বনজ ঝোপে, সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে একটা জীর্ণ দোচালা দোকান। রাস্তার এক পাশে ধানখেত, অন্য পাশে খালি মাঠ—যার পর শুরু হয় বালির চরা আর শুকনো নদীর পাড়। চারদিক এতটাই নির্জন যে দিনের আলোতেও গা ছমছম করে।দোকানটার নাম কেউ জানে না। তবে কাছাকাছি যেসব রাখাল বা কাঠুরে আসে, তারা বলে “মকবুলের দোকান”। মকবুল নামে এক লোকই দোকানটা চালায়। বয়স পঞ্চাশ কি পঞ্চান্ন। চুপচাপ প্রকৃতির। তার গলায় কোনোদিন জোরে কথা কেউ শোনেনি। একা আসে, একা বসে, সন্ধ্যা নামার আগেই তালা মেরে চলে যায়।এই দোকানের অদ্ভুত ব্যাপার হলো—এখানে কোনো বিক্রিবাট্টা চলে না।না, ভুল নয়। দোকানে মালের অভাব নেই—চাল, ডাল, তেল, বিস্কুট, চা, সাবান, এমনকি সিগারেট পর্যন্ত। কিন্তু কেউ চাইলেও কিছু বিক্রি করে না মকবুল।যদি কেউ বলে, “একটা সাবান দেন,” সে কেবল তাকায়। কিছু বলে না। এমনকি টাকা বাড়িয়ে ধরলেও নেয় না।তবু, প্রতিদিন সকালে দেখা যায় দোকানের তাক খালি হয়ে গেছে।রাতের বেলা এখানে কী ঘটে?গল্প এখানেই শেষ নয়, বরং এখান থেকেই শুরু।রানা ও শহিদ—দুজন তরুণ, সাহসী এবং গ্রামের বাইরের কলেজে পড়ে। তাদের বন্ধুত্ব ছেলেবেলা থেকে। শহিদ গ্রীষ্মের ছুটিতে গ্রামে ফিরেছে, আর রানা এই এলাকারই বাসিন্দা।একদিন সকালে তারা দেখতে পেল—মকবুলের দোকানে আগের দিনের তুলনায় মাল অনেক বেশি।“দেখেছিস রে, এই দোকানে প্রতিদিন মাল জমে, কিন্তু বিক্রি হয় না!” শহিদ বলল।রানা হেসে বলল, “রহস্যময় দোকান। চল, একদিন রাতে দেখে আসি।”বয়স কম, কৌতূহল বেশি। পরদিন রাতে তারা গেল দোকানটার পেছনে। ঘড়িতে তখন ১২টা বেজে ৪০ মিনিট।চারদিক থমথমে। কেবল শিয়ালের ডাক আর বাতাসে গাছের পাতার খসখস। হঠাৎ এক সময় দেখা গেল, দোকানের দরজাটা ধীরে ধীরে নিজে নিজেই খুলে গেল।কোনো মানুষ নেই, আলোও নেই। শুধু চাঁদের আলোয় ঝাপসা এক ছায়া ঘরে ঢুকে পড়ল। এরপর ভেতর থেকে শোনা গেল কেমন যেন ফিসফিস শব্দ—তাদের ভাষা বোঝা যাচ্ছিল না, যেন বহু মানুষের একসাথে নাভিশ্বাস ধরা গুঞ্জন।রানা ও শহিদ তাকিয়ে দেখে, তাকের মাল একে একে উঠে যাচ্ছে। বিস্কুট, ডালের প্যাকেট, চালের বস্তা—সব যেন নিজে নিজে উড়ে যাচ্ছে অদৃশ্য কারও হাতে। কেড়ে নিচ্ছে কোনো এক অদৃশ্য বাহিনী।আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার—দোকানের চারপাশে ধীরে ধীরে জমতে লাগল ধোঁয়ার মতো কুয়াশা, যেটা থেকে এক এক করে গড়াতে লাগল ছায়ামূর্তি—দীর্ঘ, রোগা, চোয়াল ভাঙা, চোখ গহ্বর ছাড়া, হাড়জিরজিরে পায়ের আওয়াজ। তারা মাল নিচ্ছে, পরস্পরের সঙ্গে চোখে চোখ রাখছে, কিন্তু কোনো শব্দ নেই।একটি পুরনো কণ্ঠস্বর কানে এল—“এই দোকান আমাদের… মৃতদের হাট… প্রতি রাতেই আসে ক্রেতা, দেয় মকবুলকে দাম… যা টাকা নয়… প্রাণ, সময় আর নিঃশ্বাস…”হঠাৎ এক ছায়া ঘুরে তাকাল শহিদের দিকে। শহিদ চিৎকার দিয়ে উঠল—সে মুখহীন এক ভৌতিক অবয়ব। তার চোখ নেই, কিন্তু তার তাকানোটাই যেন পুড়িয়ে দেয় মন।রানা টেনে ধরে শহিদকে, দু’জনে দৌড়ে পালিয়ে এল।পেছনে আর তাকায়নি তারা।পরদিন তারা দেখতে গেল মকবুলকে। সে প্রতিদিনের মত চুপচাপ বসে আছে। চোখে একরকম ক্লান্তি, যেন রাতভর কোনো ভার বহন করেছে।রানা সাহস করে বলল, “আপনার দোকানে রাত হলে কী হয় জানেন তো?”মকবুল ধীরে তাকাল তাদের দিকে। তারপর বলল, “তোমরা দেখে ফেলেছো?”তাদের বুক কেঁপে উঠল।মকবুল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “তোমরা শুনতে চাও? তাহলে শোনো…”“…এই দোকান আমার বাবার ছিল। সেই সময় যুদ্ধ চলছিল—১৯৭১। বাবার দোকানে এক রাতে আশ্রয় নেয় কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। খবর পেয়ে রাজাকাররা দোকানটা ঘিরে ফেলে। সবাইকে পুড়িয়ে মারে। আমার বাবা বেঁচে ছিলেন, কিন্তু তার চোখের সামনে… চোখের সামনে পুড়ে যায় আটজন মুক্তিযোদ্ধা, এক মা তার ছোট ছেলেকে জড়িয়ে ধরে পুড়ে মরে…”“…দোকানটা অভিশপ্ত হয়ে যায়। কেউ কাছে আসে না। পরে এক রাতে আমি শুনি ডাক—‘দোকান খুল, আমরা আবার ফিরে এসেছি…’ সেদিন থেকেই রাত হলেই ক্রেতারা আসে। তারা মৃত, তারা শিকার খোঁজে। আমি বিক্রি করি না—আমি জমা রাখি… আর তারা নিয়ে যায়…”“তারা এখন আমার শরীর ছেড়ে যাবে না। যতদিন দোকান খোলা থাকবে, আমি বেঁচে থাকব। এক রাতে যদি না খোলো… তারা আমাকেও নিয়ে যাবে…”রানা ও শহিদ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে।মকবুল ধীরে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায়, বলে,“তোমরা আর কখনো রাতে এসো না… যাদের চোখে পড়ে গিয়েছে, তারা বেশিদিন টিকে না…”এর এক সপ্তাহ পরে, শহিদ হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়। তার জুতো, ব্যাগ পাওয়া যায় নদীর পাড়ে।রানা হতভম্ব। পুলিশের কাছে যায়, মকবুলের কথাও বলে। কেউ বিশ্বাস করে না।তবে, ঠিক পরদিন থেকে, দোকানটা বন্ধ।দোকানটা আর খোলা হয়নি। কেউ মকবুলকেও দেখেনি। রাত হলেই দোকানটা অন্ধকার থাকে, দরজা বন্ধ।কিন্তু গ্রামের রাখালরা বলে—রাত গভীর হলে, কেউ কেউ এখনো ফিসফিস আওয়াজ শোনে দোকানের পাশ দিয়ে হাঁটলে। আর দোকানের সামনে ছোট্ট একটা কাঠের ফলকে লেখা—\"ভুতের হাট – খোলা কেবল মৃতদের জন্য
0 Comments