সন্ধ্যাবেলার রেলস্টেশন। লালমাটির উপর লেগে থাকা হালকা কুয়াশায় ভেসে বেড়ায় একটা নাম—\"অয়ন\"। গ্রামের দরিদ্র এক ছেলের নাম, যার চোখে ছিল স্বপ্ন, আর হৃদয়ে ছিল এক অনুচ্চারিত ভালোবাসা।অয়ন ছিল স্টেশনের পাশের একটা চায়ের দোকানে কাজ করা ছেলেটি। প্রতিদিন বিকেলে সে একই সময়ে একটা মেয়েকে দেখতে পেত—ট্রেনে করে শহর থেকে পড়তে আসা, ধনী পরিবারের মেয়ে \"আরিবা\"। মেয়েটির হাতে দামি বই, চোখে চশমা, আর পোশাকে শহরের আভিজাত্য। অয়ন কখনো তার সাথে কথা বলেনি, শুধু চুপচাপ দেখত—যেন তার জীবনের একমাত্র ছবি আরিবা।একদিন ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় হঠাৎ পড়ে যাচ্ছিল আরিবা। সবার অজান্তে ছুটে গিয়ে তাকে ধরেছিল অয়ন। আরিবা কিছু না বললেও একপলকের জন্য তাকিয়ে ছিল ছেলেটার চোখে। সেই চোখে ছিল ভয়, প্রেম, আর নিজেকে আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টা।তারপর থেকে আরিবা লক্ষ্য করল, প্রতিদিন স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি একেকদিন একেকভাবে তার জন্য কিছু রেখে যাচ্ছে—কখনও হাতে আঁকা একটা ছবি, কখনও শুকনো ফুলের মালা, কখনও কবিতার ছেঁড়া কাগজ। কে করছে, জানত না সে, কিন্তু মন বলত—এই ছেলেটির মাঝে কিছু আছে, যা তার শহুরে বন্ধুদের মাঝে নেই।একদিন সে সেই ছেঁড়া কাগজে একটা চিঠি পেল—> “আমি জানি, আমরা দুই জগতের মানুষ। তোমার পৃথিবী যেখানে আলোয় ঝলমলে, আমি সেখানে ছায়া। তবু আমি প্রতিদিন তোমার জন্য কিছু রেখে যাই, কারণ এটুকুই আমার সাহস। হয়তো কোনোদিন তুমি বুঝবে না, তবু আমি চুপচাপ ভালোবাসি। –অ” সেই রাতেই প্রথমবারের মতো আরিবা কেঁদে ফেলেছিল।পরের দিন সে সিদ্ধান্ত নেয় ছেলেটিকে খুঁজবে। কিন্তু স্টেশনে গিয়ে জানল—অয়ন আর নেই। অনেকদিন ধরেই তার একমাত্র মা অসুস্থ ছিল, ওষুধের অভাবে মারা গেছে। মাকে কাঁধে করে চিতায় তুলেই সে হারিয়ে গেছে পৃথিবী থেকে। কেউ জানে না সে কোথায়।আরিবার চোখে জল, হাতে চিঠি।তারপর থেকে সে প্রতিদিন স্টেশনে যায়, সেই পুরনো বেঞ্চিতে বসে, যেন একদিন অয়ন হেঁটে এসে বলবে,\"আজ একটু সাহস করে বলি, আমি তোমায় ভালোবাসি...\"
0 Comments