চাঁদের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলে তুমিই

রেলস্টেশনটা অনেক পুরোনো। প্ল্যাটফর্মের সিমেন্টে ফাটল ধরেছে, সময়ের মতো। সন্ধ্যার হালকা আলোয় শহরটা যেন একটু বেশি নিঃসঙ্গ লাগে। ট্রেন আসতে এখনও অনেক দেরি — ঘড়িতে ৭টা ৪২ বাজে।সিপন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। চোখের দৃষ্টি ট্র্যাকের দিকে, কিন্তু মন পড়ে আছে আট বছর পেছনে।সেই একই রেলস্টেশন।সেই একই সন্ধ্যা।তবে তখন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ছিল জান্নাত।⏳ ফিরে দেখাসিপনের আর জান্নাতের প্রথম দেখা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে। জান্নাত সবসময় চুপচাপ বই পড়ত। নিজের মতো থাকত, কারও সঙ্গে মিশত না তেমন। কিন্তু সিপনের চোখে সে ছিল এক রহস্য। যেন তার ভেতরে এক আস্ত কাব্য বাস করে।একদিন বই খুঁজতে গিয়ে তাদের হাত একসঙ্গে একটা কবিতার বইয়ে পড়ল — “হিমঘরে কবিতা”।জান্নাত হেসে বলেছিল, “এই বইটা আমি আগে পড়িনি, তুমি?”সিপন উত্তর দিয়েছিল, “আমি তোমাকেই আগে পড়িনি।”সেদিন থেকেই তাদের কথা বলা শুরু। কিন্তু প্রেম? না, কেউই বলেনি। হয়তো ভেতরে ভেতরে দু’জনেই ভালোবেসেছিল, কিন্তু মুখে কখনও বলা হয়নি।শেষ বর্ষে এসে জান্নাত হঠাৎই জানায় —“আমি কানাডা যাচ্ছি। হয়তো ফিরব না।”সিপন শুধু জিজ্ঞেস করেছিল, “তুমি চেয়েছো?”জান্নাত কিছু বলেনি। শুধু একদিন রেলস্টেশনে এসে বলেছিল, “বিদায়টা যেন সুন্দর হয়, তাই প্ল্যাটফর্ম বেছে নিলাম। কেউ না কাঁদুক।”সেই শেষ দেখা।🌙 আট বছর পর: বর্তমানেআজ সিপন এসেছিল এক বন্ধুকে এগিয়ে দিতে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার মন খুঁজছিল এক অতীতকে।হঠাৎ পেছন থেকে এক মিষ্টি, নরম গলা —“আচ্ছা, এখনও কি তুমি বই পড়ে অপেক্ষা করো ট্রেনের জন্য?”চোখ ঘুরিয়ে সিপন থমকে গেল।সামনে দাঁড়িয়ে জান্নাত।চাঁদের আলোয় ওর মুখটা ঠিক সেই আগের মতোই। কেবল চোখে যেন একটু বেশি গভীরতা।সিপনের ঠোঁট কেঁপে উঠল, “তুমি কি... তুমি এখনো...?”জান্নাত হেসে বলল, “তোমার অপেক্ষা করিনি।শুধু একটা অসমাপ্ত কবিতার শেষ লাইন লিখতে এসেছি।”ওর হাতে এখনো একটা বই। নিজের লেখা। প্রথম পাতায় সিপনের নাম লেখা –\"যাকে বলা হয়নি কিছু, তাকেই আজ সব বলি\"– জান্নাত সিপন কিছু বলল না। কেবল একপাশে বসে পড়ল।ও বলল, “তুমি পালিয়ে গিয়েছিলে কেন?”জান্নাত উত্তর দিল, “আমি পালাইনি, সময় আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তুমি তো থাকতেই পারোনি মনে হয়…”সিপনের চোখে জল চলে এলো,“তুমি যা রেখে গিয়েছিলে, সেটা নিয়ে থাকা যায় না। সেটা নিয়ে শুধু অপেক্ষা করা যায়... জান্নাত।”এক মুহূর্ত চুপচাপ... শুধু পাশের ল্যাম্পপোস্ট থেকে ছায়া পড়ে সিপনের মুখে।চাঁদের আলোয় জান্নাত তার দিকে তাকিয়ে বলল—“চাঁদের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলে তুমিই।আমি বারবার ভেবেছি, এই আলো শুধু কল্পনা।কিন্তু না… তুমি বাস্তব হয়ে ফিরেছো।আর আমি এবার কোনো ট্রেন ধরব না।”সিপন একটু এগিয়ে গিয়ে ওর হাত ধরল।জান্নাত প্রথমে চমকে উঠল, তারপর চোখ বন্ধ করে শান্ত হয়ে গেল।🌌 শেষ দৃশ্যরেলস্টেশনের ঘড়িতে সময় ৮:৪৭।ট্রেন এসেছে।অনেক যাত্রী নেমে গেছে।কিন্তু দুইজন রয়ে গেছে চুপচাপ, পাশাপাশি —একটা কবিতা শেষ করতে…একটা ভালোবাসা শুরু করতে।শেষ