

গল্পবিলেতি মেমআফছানা খানম অথৈনেহা উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করা বিলেতি মেম।শহর থেকে গ্রামে এসেছে বেড়াতে।অবশ্য সেই সঙ্গে গ্রামটাও ঘুরে দেখা।চাচাতো বোন ফারহানাকে নিয়ে বের হলো।বিকেলের মিষ্টি রোদ গায়ে পড়ছে।তাপমাত্রা কম ভালোই লাগছে।গ্রামের আঁকা বাঁকা রাস্তায় হেটে চলেছে।কিছুদূর হাটার পর তাদের সামনে পড়ল হাসানদের বাড়ি।হাসান অপরিচিত কেউ না।ফারহানার প্রাইভেট টিচার।মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে।এখনো চাকরী হয়নি।তাই টিউশনি করছে।ফারহানা তার ছাত্র।আজ হাসানের বোন ঝুমার বিয়ে,গায়ে হলুদ।বাড়িভরা মেহমান।সবাই হাসি তামাসা করে চলেছে।মহিলারা হলুদ, মেহেদি বাটছে আর গান গাইছে,এতদিন ছিলারে মেতি গাছেরও ডালেআজ কেনে আইলারে মেতি ঝুমার ও হাতে ......................................................।সবাই এক সঙ্গে বিয়ের আঞ্চলিক গান গেয়ে চলেছে।তালে তালে কেউ নাচ্ছে।আগেকার দিনে বিয়ের অনুষ্ঠানে এসব গান গাওয়া হত।এখন অবশ্য নেই।খুব ভালো লাগছে।নেহা ও ফারহানা অনুষ্ঠানে যোগ দিলো। নেহাকে দেখে সবাই অবাক।এমন ছোট পোশাক পরা মেয়েটি কে?হাসানের দাদির চোখ উপরে উঠে গেল।তিনি বলেন,হায় আল্লাহ হায় আল্লাহ এমন ছোট পোশাক পরছ ক্যান।গুনা অইব।তোমার বাবার ট্যাকা নাই বুঝি।তাই অমন পোশাক কিন্যা দিছে?তার কথার সুত্রধরে বিয়ে বাড়ির জোয়ান বুড়া সবাই একবাক্যে বলে উঠল,আপনি ঠিক কইছেন।উনার বাবার ট্যাকা কম তাই মাইয়্যারে বড় কাপর কিন্যা দিবার পারে নাই।হা হা হা হো হো হো হো।সবার হাসি দেখে নেহার রাগ চরমে উঠে গেল।সে কড়া ভাষায় বলল,গেঁয়ো ভূত,ফ্যাশন বুঝেনা,রাবিশ।আমি তোমাদের ছাড়ব না।পুলিশে দেব।অপমানের প্রতিশোধ নেব।রেগে আগুন নেহা।তরতর করে কপাল থেকে ঘাম ঝরছে।যদি থানা পুলিশ করে বসে।ভয়ে হাসানের হৃদকম্প শুরু হলো।হাসান তাদের পিছুপিছু গিয়ে নম্রস্বরে বলল,সরি মেম।ক্ষমা করুণ।হাসান দেখতে কিন্তু খারাপ না হ্যানসাম,ভদ্র,নম্র।নেহাতো দেখে অবাক।গ্রামে এমন হ্যানসাম ছেলে দারুণ লাগছে।সে তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।হাসান ভাবল তার রাগ এখনো পরেনি।তাই আবার বলল,সরি মেম বললামতো ভুল হয়ে গেছে।না মানে আপনি কে?তার উত্তরের অপেক্ষা না করে ফারহানা বলল,উনার নাম হাসান।বজল চাচার ছেলে।আজ যার বিয়ে হচ্ছে তার বড় ভাই।ওদের পক্ষ হয়ে সে তোর কাছে মাফ চাইছে।ওহ এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝলাম।আচ্ছা হাসান ভাই,গ্রামের মানুষগুলো এত নোংরা কেনো?ফ্যাশন বুঝেনা।ছোট পোশাক বলে যাতা বলল।আসলে মেম হয়েছি কি,আমাদের গ্রামের মানুষগুলো খুব সহজ সরল।বড় পোশাক পরে,যেমন ধরুন মেয়েরা সেলোয়ার কামিজ,আর বউ শ্বাশুড়িরা শাড়ি মেকসি পরে।কেউ আপনাদের মতো থ্রি সাইজ স্কীন ফ্যান্ট গেঞ্জি পরেনা।তাছাড়া মেয়েদের পোশাক পরতে হয় টাখনুর নিচে,আপনি পরেছেন টাখনুর উপরে।তাই ছোট পোশাক বলেছে আরকি।হাসান ভাই এটাতো আধুনিকতা।আসলে সত্য কথা বলতে কি মেম,এটা হচ্ছে আধুনিকতার নামে বেহায়াপনা, নগ্নতা,এটা বিধর্মীদের কৃষ্টিকালচার্ড,মুসলিমদের না।ইসলাম এসব পছন্দ করেনা।আল্লাহপাক এসব পোশাক পরা নারীদেরকে দাউস বলে আখ্যায়িত করেছেন।এদের জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত।সত্যি বলছেন হাসান ভাই?জ্বি হ্যাঁ মেম সত্যি।নেহার রাগ আপাতত পরল।সে শান্ত হলো।ফারহানাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসল।হাসানের কথাগুলো ভাবতে লাগল।কেনো জানি মনের পরিবর্তন ঘটল।পরদিন ফারহানাকে নিয়ে মার্কেটে গেল।পছন্দমতো সেলোয়ার কামিজ,শাড়ি বোরকা কিনে নিয়ে আসল।তারপর এগুলো পরে আবার ঘুরতে বের হলো।হাটতে হাটতে চলে আসল হাসানদের বাড়ি।হাসান সবেমাত্র আসরের নামাজ পড়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা করল।সদর দরজায় তাদেরকে দেখে জিজ্ঞেস করল,ফারহানা মেয়েটি কে?কেনো চিনতে পারলেন না,নেহা আপু।ওহ তাই।তা মেম এমন সামাজিক পোশাক কবে থেকে?দেখুম আমাকে মেম বলে ডাকবেন না।আমার নাম নেহা।নেহা বলে ডাকুন।ঠিক আছে।তাহলে এখন থেকে প্রেকটিক্স করুণ।ওকে চলো।তিনজন পাশাপাশি হেটে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করলো।সেদিনকার নেহা আর আজকের নেহার মধ্যে অনেক পার্থক্য কেউ চিনতে পারলো না।হাসানের দাদি বলল,মাইয়্যাটা কেরে,বউ বউ লাগছে।তুই বিয়া করলি কহন?কানের কাছে ফিসফিস করে হাসান বলল,চুপ দাদি।ওহ্ আমার বউ না।তাহলে কে?ওহ্ হচ্ছে নেহা,বিলেতি মেম।ফরহাদ চাচার মেয়ে।সেদিন যে এসেছিল সে।চিনতে পারলে না?।ওহ্ চিনবার পারছি।তা বইন এবার তোমারে বালা লাগতাছে।বড় কাপরে তোমারে মানাইছে।এহন থেইক্যা এমন কাপর পইরো।জ্বি দাদি পরবো।বহ বইন বহ।বউ খারাইয়া রইলা ক্যান।ওগোরলাই নাস্তা লইয়া আহ।হাসানের মা ভিতরে গেল।দাদি নাতিন গল্পের আসর জুড়ে দিলো।নেহাকে দাদি তার জীবনের গল্প শুনাল।নেহা ও মনোযোগ দিয়ে শুনছে।বিয়ের পর শ্বশুর শ্বাশুড়ি,স্বামী সংসার,..।আমাগো আমলে তোমাগো মতন এত বেহায়াপনা ছিলো না।স্বামীর লগে তুই তোকারি করন যাইতো না।শ্বশুর শ্বাশুড়িকে খুব মান্য করতে অইত।আমাগো জীবন ছিল বহুত কষ্টের। সারাদিন কাজ আর কাজ লইয়া থাকতাম।ঢেঁকিতে ধান ভানতাম।হেই বেয়ান থেইক্যা ধান ভানা শুরু করতাম রাইত পর্যন্ত।সারাদিন খাইটতাম।একটু ভূল অইছে,শ্বাশুড়ি রাইগ্যা আগুন।অনেক বকাঝকা করত।তবুও কিচ্ছু কইতাম না।সংসারের সবাই মিল্যা মিশ্যা থাকতাম।আর এহন এসব নাই।কি কলির যুগ আইল,মায়েরে পোলা দেখবার পারেনা।বউ শ্বাশুড়িরে ভাত দেয়না,পালাইয়া দেয়।এইতো হেইদিনকার কথা, হনুফার মায়ের তার পোলার বউ নদীতে পালাইয়া দিছে।বল কী দাদি, মানুষ এত নিষ্ঠুর?হবইন।ততক্ষণে চা নাস্তা হাজির।দাদি খুব খাতির করে নেহাকে খাওয়াল।নেহা বিদায় নিলো।দাদি দাঁড়িয়ে রইল।হাসান তাদেরকে এগিয়ে দিয়ে আসল।সপ্তাহ খানেকের মধ্যে নেহার জীবনে পরিবর্তন এসে গেল।সে নামাজি ও পর্দানশীন হয়ে গেল।হাসানের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠল।একদিন সরাসরি হাসানকে ভালোবাসার কথা বলল।হাসানতো অবাক বিলেতি মেম তাকে ভালোবাসে।সে কথা কানে নিলোনা।হেসে উড়িয়ে দিলো।নেহা কিন্তু ছাড়লো না,সিরিয়াসভাবে বলল।এবার হাসান না করতে পারলো না।তার ডাকে সাড়া দিলো।দুজনের মাঝে ভালোবাসাবাসি চলছে।একে অপরকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু....।এদিকে ফারহানা জ্বলে পুড়ে ছাই।সে হাসানকে ভালোবাসত কিন্তু বলতে পারেনি।ভেবেছিল সময়মত বলবে।কিন্তু তার আগে সে অন্যের দখলে চলে গেল।কথাটা ভাবতেই মনের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠল।কান্নায় আঁখিযুগল ভিজে জবজবে।নেহা এসবের কিছুই জানে না।সে তার সামনে হাসানকে নিয়ে রোমান্স..।এসব দেখে ফারহানা ভিতরে ভিতরে কেঁদে মরছে।না পারে কইতে না পারে সইতে।নেহা হাসানের পুরো হৃদয় দখল করে তবে শহরে পাড়ি জমাল।বাবা মা বোরকা পরা বিলেতি মেমকে দেখেতো অবাক।জিজ্ঞেস করল,নেহা তোর এব অবস্থা কে করেছে?কে করবে,আমি নিজেই করেছি।না মানে বর্তমানে এমন পোশাক কেউ পরে?লোকে দেখলে হাসবে না?শুন মা লোকে হাসলে আমার কিচ্ছু যায় আসে না।এতদিন আমরা ভুল পোশাক পরেছি।এখন থেকে শুদ্ধ মানে ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক পোশাক পরব।আজ থেকে বাইরে বের হওয়ার সময় তুমিও বোরকা পরবে।এই নাও বোরকা।না আমি বোরকা পরবো না?তুই পর।প্লিজ মা বুঝতে চেষ্টা কর।এ দুনিয়া দুদিনের। মরার পর আল্লাহর কাছে কি জবাব দেবে, তা কি একবার ও ভেবে দেখেছ?ভাবনি তাই আমাদেরকে বেপর্দা মর্ডান বানিয়েছ।মা বেপর্দা মর্ডান নারীদের উপর আল্লাহর নালত।আল্লাহ কখনো এসব নারীদের ক্ষমা করবেন না।এদের জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত।মেয়ের যুক্তির কাছে মা হার মানল।মেয়ের সাথে সাথে মাও নামাজি ও পর্দানশীন হয়ে গেল।নেহা ও হাসান দুজনের মুঠোফোনে আলাপ হয়।তবুও কেন জানি মনের ভিতর শুন্যতা।একা একা লাগছে।ভালো লাগছে না।হাসানের কাছে ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে।তাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু পারছে না তাদের মাঝে বিরাট ফারাক।বাবাকে কিভাবে বলবে,সে গ্রামের হাসানকে ভালোবাসে।বাবা কি মেনে নেবেন এ ভালোবাসা।এসব ভাবনা তাকে ভাবিয়ে তুলেছে।দৃশ্যটা মায়ের চোখে পড়তেই তিনি জানতে চাইলেন,নেহা তোর কি হয়েছে?এমন মনমরা হয়ে কি ভাবছিস?কিছু না মা।আমি মা। আমার কাছে কোনকিছু লুকাস না।বল কি হয়েছে?মা আজ থাক অন্যদিন বলব।এমন সময় ফরহাদ চৌধুরী তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। তারপর বলল,নেহার মা শুন একটা সুখবর আছে।বলুন কি সুখবর।আমার বন্ধু আমজাদ চৌধুরির একমাত্র ছেলে সাজ্জাত চৌধুরির সঙ্গে নেহার বিয়ে ঠিক করেছি।সে বিলেত থেকে পি এইচ ডি।আসলে সাজ্জাত পি এইচ ডি না।বখাটে লম্পট,বাবার কাছ থেকে পড়ার নাম করে টাকা এনে বাজে নেশায় খরচ করেছে।আর মেয়ে মানুষ নিয়ে ফুর্তি করেছে।পড়ালেখায় ঠনঠন। দেশে এসে বলে পি এইচ ডি।এসব আষাঢ়ে গল্প বিশ্বাস করে ফরহাদ চৌধুরী তার মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজী হয়েছেন।কিন্তু নেহা তার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানে।তাই দেরী না করে তার সকল কুকীর্তির কথা বাবার কাছে প্রকাশ করল।সবকথা শুনার পর তিনি থবনে হারিয়ে গেলেন।কি করবেন না করবেন ভেবে পাচ্ছেন না।তবুও মেয়ের ভবিষ্যৎ বলে কথা, না করতে হবে।তিনি সরাসরি না করে দিলেন।কথাগুলো শুনার পর তারা ক্ষীপ্ত হয়ে উঠল।নেহাকে জোর করে তুলে নেয়ার হুমকি ধুমকি দিচ্ছে।তাদের বাসার সামনে সাঙ্গ পাঙ্গ নিয়ে হাজির।সুযোগ খুঁজছে কিভাবে নেহাকে তুলে নিবে।টের পায় নেহার বাবা মা।তাকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।হাসানের সঙ্গে আবার দেখা হয়।সম্পর্ক আর ও পাকা হয়।হাসানের সঙ্গে নেহার বাবা মায়ের পরিচয় হয়।নেহা তার মাকে তাদের ভালোবাসার কথা বলে।মা বাবাকে রাজী করায়।তাদের বিয়ে ঠিক হয়।এদিকে ফারহানা ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে কাঁদে।একদিন সে অসুস্থ হয়ে পড়ে।তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।ডাক্তার পরীক্ষা করে জানায় তার ক্যান্সার। সে এ পৃথিবীর বুকে আর মাত্র কটাদিন বেঁচে আছে।কথাগুলো শুনার পর মা বাবা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।ভেঙ্গে পড়ে হাসান ও নেহা।ফারহানার জন্য নেহার খুব খারাপ লাগে।সে তার খুব সেবাযত্ন করে।বেঁচে থাকবে বলে বুঝ ভরসা দেয়।কিন্তু ফারহানা জানে সে আর বাঁচবে না। তাই ডুকরিয়ে কাঁদে।তার কান্না যেন শেষ হচ্ছে না।এর ফাঁকে কেটে গেল সপ্তাহ দুয়েক।আজ তার অবস্থা ভালো না।সে বিছানায় ছটপট করছে।তাকে দেখতে এসেছে হাসান।সে নেহার হাত ধরে কেঁদে কেঁদে বলে,নেহা আপু যাবার বেলায় তোকে একটা সত্য কথা বলতে চাই।কিছু মনে করবে নাতো?না করব না বল।আমি হাসান ভাইকে ভালোবাসতাম।কিন্তু কোনদিন বলতে পারেনি।আজ বলতে আর কোন দ্বিধা নেই।আমি হাসান ভাইকে আমার জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসতাম।যখনি বলার জন্য প্রস্তুত হলাম,তখনি দেখলাম তুই তাকে ভালোবাসিস।তাই আর বলিনি।আজ বিদায় বেলায় বলে গেলাম।তোরা সুখে থাকিস,শান্তিতে থাকিস।হাসান ভাইকে কখনো কষ্ট দিসনা।উঁ উঁ আ: আ: আমার কেমন জানি লাগছে।সে আর কথা বলতে পারলনা।মারা গেল।সবাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।ফারহানাকে দাফন করা হল।সময়মত নেহা আর হাসানের বিয়ে হল।\"বিলেতি মেম\" হলো গ্রামের আদর্শ বউ।
0 Comments