রাতের রানী

আবীর ছিল একাকী যুবক, সদ্য শহর থেকে ফিরেছে নিজ গ্রামের পুরনো ভাঙা দোতলা বাড়িতে। বাবা-মা নেই, চাকরি পায়নি, চারদিকে হাহাকার। শুধু ছিল এক টুকরো চাঁদনী রাত আর পদ্মার ঢেউয়ের শব্দ।এক রাতে হঠাৎ করেই তার ঘরে ঢুকে পড়ে এক অপরূপা নারী। কেশরাশি যেন অন্ধকার আকাশে তারার মায়া মেখে আছে, চোখে রূপালি দীপ্তি, কণ্ঠে এক মায়াবী সুর। আবীর হতচকিত, ভয় পায়, কিন্তু মেয়েটি হাসে শুধু। বলে,— “চলো আমার সাথে, নদী তোমায় ডাকছে।”আবীর যেন সম্মোহিত। কিছু না ভেবেই মেয়েটির সাথে বেরিয়ে পড়ে। বাড়ির পেছনের গলিঘুঁজি পেরিয়ে নদীর ঘাটে আসে। সেখানে বাঁধা একটা ছোট্ট নৌকা, যেন সে নৌকাটা কেবল তাদের জন্যই তৈরি।মেয়েটির নাম জানতে চায় আবীর, মেয়েটি শুধু বলে—— “আমি রাতের রানী। দিনের আলোয় আমি নেই। কিন্তু রাতে আমি শুধুই তোমার।”তারপর শুরু হয় প্রতিরাতে তাদের রহস্যময় যাত্রা। তারা নদী পার হয়, ঘুরে বেড়ায় সাদা কুয়াশার ভেতর, কখনো অজানা পাহাড়ে, কখনো গহীন বনানীতে। যেন এক পরীর রাজ্যে তাদের প্রেম খেলে বেড়ায়। আবীর ধীরে ধীরে বুঝে ওঠে, এটা কোনো স্বপ্ন নয়, তবে বাস্তবও নয়।দিনে সে নিজের ঘরে ফিরে আসে, চোখে বিস্ময় আর মনে ভয়। কারো সাথে সে কথা বলে না। প্রতিদিন সকালে নৌকায় তার গায়ে পাওয়া যায় একটি সুগন্ধী ফুল— যা এই উপমহাদেশে কোথাও নেই।একদিন সে সাহস করে দিনেও মেয়েটিকে খুঁজতে বের হয়। নৌকা নেই, নদী শান্ত, সেই ঘাটে একটা শুঁয়োপোকাও নড়ে না। গ্রামের একজন বৃদ্ধ বলে—— “তোর দাদার আমলেও এই রকম এক মেয়ে আসত রাতের বেলা। তোর দাদারও এমনই দশা হয়েছিল… শেষে এক রাতে সে আর ফেরেনি।”আবীর ভাবল এবার আর যাবে না। কিন্তু রাতে মেয়েটি আবার আসে। আজ তার চোখে জল। বলে,— “তুমি আমাকে ছেড়ে যাচ্ছ? আমি তো শুধু তোমার জন্য এসেছি। তুমি জানো না, আমি কোথা থেকে এসেছি…”আবীর বলে,— “তুমি কি মানুষ? না পরী? না অন্য কিছু?”মেয়েটি হেসে বলে,— “আমি প্রেম, আমি অপেক্ষা, আমি রাতের মায়া। আমি তোমার ভাগ্যে লেখা এক অনন্ত ভ্রমণ।”সেই রাতে তারা শেষবারের মতো নদীতে নামে। আবীর আর ফিরে আসে না।পরদিন সকালবেলা গ্রামের জেলেরা দেখে, সেই পুরনো নৌকাটা মাঝনদীতে ডুবে আছে। পাশে ভাসছে একটি সুগন্ধি ফুল— যেটার অস্তিত্ব এই দুনিয়ায় নেই।গ্রামে এখনো মানুষ বলে, চাঁদনী রাত হলে, পদ্মার পারে নাকি এক জোড়া ছায়ামূর্তি দেখা যায়— এক তরুণ, এক তরুণী— নদীর বুকে নৌকায় ভাসে।তারা জানে না, এ প্রেম কোন জন্মের, কোন মৃত্যুর...