বৃষ্টিভেজা এক বিকেল। জান্নাত বারান্দায় দাঁড়িয়ে, হাতে কফির মগ। পাশে ছোট্ট তওফা, চার বছর বয়স — চুলে দুটো বেণী, কৌতূহলী চোখে জিজ্ঞেস করে,“মা, তুমি কাঁদছো?”জান্নাত একটু হেসে বলল,“না মা, চোখে শুধু বৃষ্টি ঢুকেছে।”পেছনে এসে সিপন মেয়েকে কোলে তুলে নেয়, বলে,“তোমার মা বৃষ্টি পছন্দ করে। কিন্তু আমি শুধু ওর হাসিটা পছন্দ করি।”ওদের সংসারটা ছিল ছোট, কিন্তু পূর্ণ।তিনজনের ঘরে ছিল ভালোবাসার ঘ্রাণ, রান্নার মসলা, আর প্রতিদিনের ছোট ছোট স্মৃতির লুকোচুরি।তওফা রাতে ঘুমোতে যেত মায়ের গল্প শুনে —“এক যে ছিল রাজকন্যা, তার নাম তওফা… আর রাজা-রানী ছিল মা আর আব্বু…”কিন্তু হঠাৎ করেই জান্নাতের শরীর খারাপ হতে শুরু করল।জ্বর, দুর্বলতা, ক্লান্তি — ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছিল সে।সিপন রিপোর্ট হাতে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিল, যখন ডাক্তার বলল,“জান্নাতের শরীরে ক্যানসার ধরা পড়েছে। সময় খুব বেশি নেই…”জান্নাত জানত, তার সময় গোনা শুরু হয়ে গেছে।কিন্তু তওফার সামনে সে সবসময় হেসে থাকত।একদিন মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলল,“তুই জানিস মা, তোর মুখটা দেখলেই আমার ব্যথা কমে যায়।”তওফা জিজ্ঞেস করল,“তুমি তাহলে কেন ওষুধ খাও?”জান্নাত চোখ মুছে বলল,“কারণ আমি তোকে স্কুলে পৌঁছে দিতে চাই, মা। আমি চাই তুই বড় হয়ে আমার মতো শক্ত মেয়ে হস।”কেমোথেরাপি শুরু হলো। জান্নাতের চুল পড়ে যেতে লাগল।একদিন আয়নায় তাকিয়ে বলে উঠল,“আমি কি আর সুন্দর নেই?”সিপন তার মাথায় চুমু দিয়ে বলল,“তুই এখনো আমার সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটা। আমি চুলে নয়, ভালোবাসায় সৌন্দর্য দেখি।”তওফা মাকে নিজের আঁকা ছবি উপহার দেয়। বলত,“মা, আমি আজ তোমার জন্য সূর্য এঁকেছি… যেন তোমার মাথা ব্যথা না করে।”একদিন রাতে ছাদে জান্নাত চুপ করে বসে ছিল। সিপন পাশে গিয়ে বসতেই বলল,“আমার যদি কিছু হয়ে যায়, তুই তওফার আব্বু না, মা হয়ে যাস… ও যেন বোঝে, ভালোবাসা শুধু ছুঁয়ে দেখার জিনিস না… অনুভব করারও।”সেই রাতটাই ছিল শেষ ছাদে দেখা চাঁদ।💔 সেই শেষ রাত...হাসপাতালের বিছানায় জান্নাত নিঃশেষ। মুখে রঙ নেই, চোখে নিঃশেষ আলো।তওফা পাশে বসে বলছে,“মা, তুমি আজ গল্প বলবে না? আজকে তো রাজকন্যার উড়োজাহাজের গল্প বলার কথা…”জান্নাত শেষ শক্তিটুকু নিয়ে মেয়ের গালে হাত বুলিয়ে বলল,“আজ তুই গল্প বল, মা… আমি শুনব…”তারপর চোখ বুজে নেয় সে। সিপন তওফাকে আলতো করে কোলে তুলে নেয়, আর জান্নাতের ঠান্ডা হাত ধরে বলে,“তুমি বলেছিলে চাঁদ হয়ে থাকবে… আমি তওফাকে নিয়ে রোজ তাকাবো সেই আকাশে।”🕯️ এক বছর পর...তওফা এখন স্কুলে যায়। ছবি আঁকে, গানে গানে মাকে ডাকে।রাতে সে জানালার পাশে বসে বলে,“আব্বু, চাঁদটা কি এখনো মাকে দেখায়?”সিপন জানালায় বসে মেয়ের চুলে বিলি কাটে, বলে,“তোর মা তো তোকে দেখতে একটুও ভুলে না। ও চাঁদ হয়ে তোর খেয়াল রাখে, মা।”তওফা ছোট্ট একটা চিঠি লিখে জানালায় রাখে —“মা, তুমি ভালো আছো তো? আমি আজ চাঁদকে বলেছি, তোমাকে আমার ছবি দেখাক।”আকাশে পূর্ণিমা, সাদা নরম আলোয় ভেসে আছে ছাদের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা এক বাবা-মেয়ে…আর সেই আলোয় লুকিয়ে আছে এক চিরন্তন ভালোবাসা,একজন মা — জান্নাত…একজন স্বামী — সিপন…একটি মেয়ে — তওফা…আর চাঁদের মতো এক নিঃশব্দ প্রার্থনা।
“তুমি থাকো আমার চাঁদ হয়ে” এক হৃদয়ছোঁয়া বাস্তবধর্মী রোমান্টিক ড্রামা, যেখানে এক মায়ের ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই, এক স্বামীর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, আর এক ছোট মেয়ের নির্দোষ অনুভূতি মিলেমিশে গড়ে তোলে এক অবিনাশী ভালোবাসার চিত্র।জান্নাত, সিপন ও তাদের চার বছরের মেয়ে তওফার ছোট্ট সুখের সংসার হঠাৎই ক্যানসারের ছায়ায় ঢাকা পড়ে। কিন্তু ভালোবাসা হেরে যায় না।জান্নাত চলে গেলেও তার ভালোবাসা রয়ে যায়—চাঁদের আলোয়, মেয়ের হাসিতে, আর সিপনের হৃদয়ে…এটি শুধুই একটি গল্প নয়, এটি প্রতিটি ভালোবাসার মানুষের কাছে একটি জীবনের প্রতিচ্ছবি।
0 Comments