বয়সটা যখন খালি গায়ে হাফ প্যান্ট পরে ছুটে বেড়ানো, তখন কদম ফুলের ব্যবহার ছিল নিতান্তই একটা হলুদ রঙা বলের মতো। কদম গাছের নিচে ঘুরঘুর করতাম।আস্ত,সুন্দর কদম পেয়েছি বলে মনে পরছে না।ফাটা,পঁচা,থেঁথলানো কদম নিয়েই চূড়ান্ত খুশি হয়ে যেতাম।শৈশবে আমার খুব অল্প সময় গ্রামে কেটেছে, তাই কদমতলায় গিয়ে আস্ত কদমের অপেক্ষা করার মতো সময় পাই নি।যারা আমার সাঙ্গপাঙ্গ ছিল,এদের মধ্যে আমিই জেষ্ঠ্য ছিলুম কিনা,গম্ভীর মুখ করে একদিন ঘোষণা দিলাম- কদম আসলে এমনি হয়,ফাটা,থেঁথলানো।আমার সাঙ্গপাঙ্গরা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।ওদের কেউ কেউ বুঝতে পেরেছে হয়তো কিন্তু দুকথা বলার সাহস ছিল না।যাক সেসব আজগুবি শৈশবকাহিনী।তারপর আমি বড় হলাম,বড় বলতে আহামরি না - ক্লাস ৮/৯।টিভিতে চলছে মাসব্যাপী ঈদের প্রোগ্রাম। আমি ছিলাম ঈদ প্রোগ্রামের বিশাল ভক্ত।কতবড় ভক্ত একটা নমুনা দেই।আমাদের গোলাপী রঙের দেয়ালে কলম দিয়ে ঈদের প্রোগ্রামের সময়সূচি লিখতাম।একদিন আমার বাপের চোখে পরলো।আমার ডাক পরলো,উনার ইয়া বড় চোখ আমাকে সংকেত দিচ্ছিলো - ভাগ ভাগ,দে দৌড়। দূর্ভাগ্যবশতঃ আমি দৌড় দিতে পারি নি।দেয়ালের একটা অংশ জুড়ে ঈদ প্রোগ্রামের সময়সূচি, দূর থেকে দেখে মনে হয় কালো পিঁপড়ের দল সারিবদ্ধভাবে পিটি করছে।ঈদের দ্বিতীয় দিন সম্ভবত একটা টেলিফিল্ম দিলো(নাম মনে নেই),ওখানে নায়িকা নৌকায় বসে কদমহাতে ভিজছিলো।তার চোখে ছিল জল।ওই থেকে কদমের সংজ্ঞা পালটে গেলো।ছোট থেকে চারপাশে এত গল্পের বই দেখে বড় হয়েছি,কাল্পনিক হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমার মা,ডান হাতে খুন্তি নাড়তো, বাঁ হাতে আস্ত মোটা মোটা সব উপন্যাস পড়তো। মায়ের ছিলো দারুণ গানের গলা,বিশেষ করে রবীন্দ্র সংগীত। আমি নাক কুঁচকে বুঝার চেষ্টা করতাম,এমন ঝিমানো গান কেউ কি করে পছন্দ করে?কিন্তু এখন আমিও ঝিমানো গান চালিয়ে বৃষ্টি বিলাস করি।এবার বলি,কদম নিয়ে আমার ধারণা পাল্টানো বিষয়ে।তখন সদ্য প্রেমে পরা একটা কম-বয়সী যুবতী আমি। স্বর্নেন্দু নাম এক চরিত্রের প্রেমে পরেছি,যে ছিল সমরেশ মজুমদারের এক সৃষ্টি। যাক সেসব,এই স্বর্নেন্দুর চরিত্র এতটাই প্রভাব ফেলে আমার উপর, আমি মনে মনে একটা অবয়ব বানাই, যেখানে এই লোকের পরনে হাল্কা নীল পাঞ্জাবী,চোখে চিকন ফ্রেমের চশমা, আর রেশমের মতো চুল,পায়ে স্যান্ডেল,হাতে একটা কালো লেদারের ঘড়ি।এই লোক একটু পর পর চশমা ঠিক করে এবং অত্যন্ত মিষ্টভাষী।আমার মায়ের সিলভার কালার একটা ফোন ছিল,অসংখ্য রবীন্দ্র সংগীতের ভীড়ে একদিন মা প্লে করে \"বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল,করেছো দান\"। টং করে গানের লাইন গুলো আমার হৃদয় ছুঁয়ে যায়।এই প্রথম কোন ঝিমানো গান আমি মন দিয়ে শুনি এবং শুনতেই থাকি।কদম নিয়ে আমার প্রেমের সূচনা সেই থেকে প্রবল হয়। আমি প্রথম একটা গল্প লিখি,বলা যায় কপি করি, খেঁকশিয়াল আর মুরগির বাচ্চার গল্প, তখন আমি ক্লাস ৪ এ পড়ি।কি প্রশংসা চারদিকে আমার! মায়ের এক কলিগ,উনি তো আমায় বলেই দিলেন,লিখ লিখ আমি পত্রিকায় দিবো তোর লিখা।ব্যস হাবিজাবি লিখা আর থামায় কে?আমার প্রথম পাওয়া বই উপহার ছিল আমার সেই আংকেল থেকে। তিনটে বই- ইশপের উপদেশমূলক গল্প,সুকুমার বায়ের হাসির গল্প আর রবিনসন ক্রুসো। আমার প্রিয় ছিল রবিনসন ক্রুসো।ফ্রাইডে আর রবিনসন ক্রুসোর মেলবন্ধনটা আমায় বেশ টানে।বিশ্বাস, ভরসা,ভালোবাসায় যে ভাষাটা প্রধান না এটাই বুঝি। যাক সেসব কথা,কদম প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আমার প্রিয় লেখক ছিল হুমায়ুন আহমেদ,ছিল বলবো না এখনো আছে । উনাকে আমি প্রচন্ড ভালোবাসি।ভালোবাসি বললেই মানুষ আড়চোখে তাকিয়ে, মুখ চেপে হাসে কেন কি জানি!উনাকে আমি সত্যিই ভালোবাসি,উনার সৃষ্ট সমস্ত চরিত্রগুলো।আমার ছোট বেলার বিরাট একটা অংশ কেটেছে হুমায়ুন আহমেদকে ঘিরে।বুকসেল্ফের হাফ জায়গা জুড়ে উনার রাজত্ব ছিল।কলেজ লাইব্রেরি গিয়ে আমি খুঁজে খুঁজে উনার বই পড়তাম।লাইব্রেরির ম্যামের চোখে পরলো এটা।উনি আমাকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,পছন্দের লেখক?আমি হেসে দিতেই ম্যাম বললেন,যে লেখকের বই পড়ো না কেন,বই পড়াটা ছেড়ো না,ধরে রেখো।আমি ধরে রাখি নি।এখন আমি যন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আমার মায়ের মোবাইল জুড়ে হুমায়ুন আহমেদের নাটক,সিনেমা থাকতো সবসময়ই। তখন আমার ম্যাট্রিক শেষ, বাসায় বসে নাটক দেখা,খাওয়া,আর ঘুম।একদিন মোবাইলের ছোট স্ক্রিন জুড়ে একটা নাটক প্লে করলাম।\"বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল \",এটা আমার পরিচিত সুর।আমি আগেও শুনেছি।আমি মন দিয়ে নাটক টা দেখলাম,এত সুন্দর ফ্যামিলি ড্রামা।আমি আর আমার মা মিলে চা খেতে খেতে নাটক দেখতাম।নাটক টা ছিল অসম্ভব শালীন, যদিও হুমায়ুন আহমেদের নাটক গুলো শালীনই হয়। কদম ফুল নিয়ে একটা আলাদা ভাব ছিল ওখানে।জোড়া ইলিশ দিয়ে প্রেমিকাকে প্রেম নিবেদনের মতো অদ্ভুত সিন,সাথে সস্তা কদম(জোড়া এক টাকা) পকেট থেকে বের করে হাতে তুলে দেওয়ার মতো স্নিগ্ধতা।শেষ দৃশ্যে সবাই মিলে ছাদে গিয়ে বৃষ্টি বিলাস করা। বাজছিলো সেই গান -বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল।কদম দিয়েও কাউকে ইম্প্রেস করা যায়!পৃথিবীর সব ফুলই আসলে সুন্দর।প্রেম নিবেদনে গোলাপই চায়,কি বাজে একটা নিয়ম চালু হয়ে গেছে। কদিন আগেই, \"বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল \" এবং \" বাদল দিনের দ্বিতীয় কদম ফুল \" দুটো বই পড়লাম।বই পড়া নিয়েও আমার বিশেষ নিয়ম আছে।উত্তপ্ত রোদে আমি বই পড়ি না,শরীর জ্বালাপোড়া করে, মাঝেমধ্যে অবশ্য পড়ি।বৃষ্টি হলেই বই পড়তে মজা,ঘুম জড়ানো চোখ,কোমর পর্যন্ত কাঁথা,হাল্কা করে ফ্যান,পরবর্তী পৃষ্ঠা পড়ার কৌতুহল কিন্তু হাত বের করে বইয়ের পাতা উল্টানোর অলসতা - সব মিলিয়ে জীবন মানেই নিজের মতো বাঁচা। এই যে কদম আমার ভালো লাগা শুরু হলো,এখন শুধু ভালো লেগেই যাচ্ছে। বর্ষা মানেই আমার কাছে কদম,প্রেম নিবেদন করতে কদম হলে মন্দ না,কদম গাছও সুন্দর,কদমের ঘ্রাণও,কদম নিয়ে কবিতা, গল্প লিখা যায়,খোঁপায় পরা যায়। এমন উদ্ভট ফুল নিয়ে আমার অদ্ভুত চিন্তা আমি কাউকে বলি না।ওরা হাসবে,গোলাপ টেনে উদাহরণ দিবে,আঙুল উঁচিয়ে সূর্যমুখীর বাগান দেখাবে,জবা ফুলের সৌন্দর্য্য বর্ননা করবে।কিন্তু আমি ফুলপ্রেমী,মায়ের কাছে মাসির গল্পের মতো কেউ যখন একটি ফুলের প্রতিযোগী করে অন্যটিকে সামনে আনে আমার ফুলের মতো কোমল মন বলে উঠে - আহাম্মক কোথাকারে তুই ফুল চিনিস?যা ভাগ এখান থেকে। কিন্তু আমি এটা কখনোই বলবো না,কারণ আমি দিলশাদের মতো মুখে কিছু বলি না,লাল স্কার্ট পরে উলটে মরে যাবো তবুও মুখ ফুটে কিছু বলবো না।
এমন উদ্ভট ফুল নিয়ে আমার অদ্ভুত চিন্তা আমি কাউকে বলি না।ওরা হাসবে,গোলাপ টেনে উদাহরণ দিবে,আঙুল উঁচিয়ে সূর্যমুখীর বাগান দেখাবে,জবা ফুলের সৌন্দর্য্য বর্ননা করবে।কিন্তু আমি ফুলপ্রেমী,মায়ের কাছে মাসির গল্পের মতো কেউ যখন একটি ফুলের প্রতিযোগী করে অন্যটিকে সামনে আনে আমার ফুলের মতো কোমল মন বলে উঠে - আহাম্মক কোথাকারে তুই ফুল চিনিস?যা ভাগ এখান থেকে। কিন্তু আমি এটা কখনোই বলবো না,কারণ আমি দিলশাদের মতো মুখে কিছু বলি না,লাল স্কার্ট পরে উলটে মরে যাবো তবুও মুখ ফুটে কিছু বলবো না।
0 Comments