শেষ চিঠি

রূপা ছিলো গ্রামের এক দরিদ্র মেয়ে। বাবা দিনমজুর, মা অসুস্থ, ছোট ভাই স্কুলে পড়ে। সংসারের ভার যেন সবসময় রূপার কাঁধেই ছিলো। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত সেলাইয়ের কাজ করতো সে, তারপর ঘরে এসে সংসারের কাজ সামলাতো। জীবন তার কাছে ছিলো যেন একটানা দুঃখের স্রোত। তবুও তার চোখে ছিলো আশ্চর্য রকমের দীপ্তি, আর ঠোঁটে লেগে থাকতো মিষ্টি হাসি। গ্রামের মানুষ প্রায়ই বলতো, “মেয়েটার চোখে যেন হাজার দুঃখ লুকানো, কিন্তু তার হাসিতে আছে শান্তি।”এক গ্রীষ্মে শহর থেকে নাহিদ গ্রামে এলো দাদুর বাড়িতে বেড়াতে। শহুরে ছেলে, আধুনিক রূপ, হাতে মোবাইল—গ্রামের সবাই তাকে নিয়ে গোপনে গল্প করতো। একদিন নদীর ঘাটে কাপড় ধুতে গিয়ে রূপার পা পিছলে যায়। মুহূর্তের মধ্যে নাহিদ তাকে জলে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচায়। সেদিন দুজনের চোখের দৃষ্টি মিলতেই যেন নতুন একটা পৃথিবী খুলে গেলো।তারপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই তারা দেখা করতে লাগলো। কখনো কাঁচা রাস্তায়, কখনো আমগাছের ছায়ায়, কখনো নদীর পাড়ে। তাদের গল্পের শেষ ছিলো না। নাহিদের কাছে রূপা হয়ে উঠলো শান্তির ঠিকানা, আর রূপার কাছে নাহিদ হয়ে গেলো আশার আলো। প্রথমবারের মতো রূপা অনুভব করলো, তার হাসি কারও কাছে গুরুত্বপূর্ণ, তার চোখে কেউ হারিয়ে যেতে চায়। ধীরে ধীরে তাদের সম্পর্ক পরিণত হলো ভালোবাসায়।কিন্তু সুখ যেন বেশি দিন থাকে না। যখন নাহিদের পরিবার জানলো তাদের ছেলের ভালোবাসার মানুষ একজন গরীব সেলাই–করা মেয়ে, তারা এক মুহূর্তও দেরি না করে সবকিছু শেষ করে দিলো। নাহিদের বাবা গর্জে উঠলো—“আমাদের ইজ্জত মাটিতে মিশে যাবে! তুমি যদি ওই মেয়েকে বিয়ে করো, তবে তুমি আর আমাদের ছেলে নও।”নাহিদ চেষ্টা করলো, বোঝালো, কাঁদলো। কিন্তু শহরের পড়ালেখা করা ছেলে হলেও এত বড় লড়াই করার সাহস তার ছিলো না। অবশেষে একদিন সে গ্রামের ঘাটে এসে রূপাকে বললো—“রূপা, আমি তোমাকে ভালোবাসি… কিন্তু আমি অসহায়। আমি পরিবারকে ছেড়ে যেতে পারবো না।”কথাগুলো শুনে রূপার বুকটা যেন ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। সে কিছু বললো না, শুধু চোখ দিয়ে নীরব অশ্রু ঝরতে লাগলো। সেই নীরব কান্নায় যেন ভেসে গেলো সমস্ত ভালোবাসা, সমস্ত স্বপ্ন।সেই রাতেই রূপা তার ছোট ভাইয়ের খাতার পাতায় লিখলো—“আমি আর পারছি না। আমি কারও বোঝা হতে চাই না। মা–বাবাকে দেখিস। আমি শুধু একটাই কথা রেখে যাচ্ছি—নাহিদকে বলিস আমি শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত ওকেই ভালোবেসেছি।”ভোরে গ্রামের পুকুরঘাটে পাওয়া গেলো ভেজা একটি ওড়না আর সেই চিঠি।খবর পেয়ে নাহিদ ছুটে এলো। পুকুরঘাটে দাঁড়িয়ে সে চিৎকার করে কাঁদলো—“রূপা… আমি তোকে চাইতাম! কিন্তু সাহস ছিলো না… আমি হারিয়ে ফেললাম তোকে চিরদিনের জন্য।”তারপর থেকে নাহিদের জীবন শুধু অনুশোচনায় ভরে গেলো। শহরের ভিড়ে থেকেও সে প্রতিদিন রূপার হাসি মনে করতো, তার চোখের দৃষ্টি মনে পড়তো। রূপা চলে গেছে, কিন্তু তার ভালোবাসা থেকে গেছে চিরদিনের জন্য।হয়তো আজও আকাশের তারা হয়ে রূপা তাকিয়ে থাকে নাহিদের দিকে। কিন্তু নাহিদের চোখে কেবল কান্না, বুক ভরে আছে শুধু আক্ষেপ—সে তার ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলেছে চিরতরে।