(এক)ভাইরাল ভিডিওটি সকলের মোবাইলে মোবাইলে ঘুরছে। ফেসবুক, ইউটিউব, পত্রিকা, টিভি চ্যানেলে মানুষ তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। ময়নাতদন্ত ছাড়াই ময়না নামের যে মেয়েটির দাফন সম্পন্ন করা হয়েছে সেটা কেন এত দ্রুত করা হলো? কেন ধর্ষককে এখনো গ্রেপ্তার করা যায় নাই? এসব নিয়ে মানুষ রীতিমতো রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। পরিস্থিতি ক্রমাগতভাবে এতটাই তীব্র হচ্ছে যে প্রশাসনকে দফায় দফায় প্রেস কনফারেন্স করে আপডেট জানাতে হচ্ছে।(দুই)সোফায় বসে রেহমান সাহেব টিভিতে বিভিন্ন চ্যানেলের নিউজ দেখছিলেন। মেয়েটি কোথায় থাকে, কাদের সাথে মেশে? পরিবারের সদস্য, কাছের আত্মীয় বা প্রতিবেশী কারা যাদের সাথে ঘনিষ্ঠতা আছে? এই প্রাথমিক তথ্যগুলো তার কাছে আছে। তবুও নিউজ থেকে বাড়তি কোনো ক্ল্যু পাওয়া যায় কিনা তাই। ঘটনার তদন্তে তিন সদস্যের যে কমিটি করা হয়েছে তিনি তাদের মধ্যে একজন। রেহমান সাহেব পেশায় সরকারী আমলা। পুরো নাম শফিকুর রেহমান। নম্র, ভদ্র, স্বল্পভাষী মানুষ। দানশীল ব্যক্তি হিসাবে এলাকায় তার বেশ সুনাম আছে। কফি হাতে পাশের সিটে বসলেন ফরিদা আক্তার। তিনি নিজ হাতে কফি বানাতে পছন্দ করেন। এক কাপ নিজের জন্য রেখে অন্য কাপ রেহমান সাহেবকে এগিয়ে দিলেন। মিস ফরিদা তার স্ত্রী, একজন মানবাধিকার কর্মী। পাশাপাশি বিভিন্ন টিভি প্রোগ্রামে উপস্থাপনা করেন। দু’দিন বাদেই জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূনআহমেদের প্রথম উপন্যাস “নন্দিত নরকে” এর উপর বিশ্লেষণধর্মী দুই পর্বের একটা অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করবেন তিনি। কফি খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে সেটারই প্রস্তুতির কথা বলছিলেন। শুরুর দিকে রেহমান সাহেবের এসবে বেশ আগ্রহ দেখা গেলেও সময়ের সাথে সাথে তার উৎসাহে ভাটা পড়েছে।তবে ভিতরে বিরক্তি থাকলেও সেটা তিনি কখনও বুঝতে দেন না।ছুটির এই এক-দুই দিন রেহমান সাহেব বেশিরভাগ সময় বাসায়ই কাটান। যদিও ফরিদা আক্তার তার নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকেন বেশি। প্রয়োজনীয় কাজের জন্য রেহমান সাহেবকে তাই কাজের লোক আর ড্রাইভারের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়।দেখতে সুন্দর আর স্মার্ট মিস ফরিদা বেশ রুটিন জীবন যাপন করেন।শারীরিক ব্যায়াম, খাওয়া, ঘুম সবই করেন নিয়ম করে। এমন পরিপাটি মিস ফরিদা\'র বিপরীতে রেহমান সাহেব অনেকটা অগোছালো, অলস এবং ভোজনরসিক প্রকৃতির। মেদসমেত ভুঁড়ি আর খানিকটা টেকো মাথায় অনেকটাই বেমানান।দুজনের সংসারে একমাত্র সন্তান তাবসীরা জান্নাত বেসরকারি ক্যাডেট কলেজে পড়ছে। নিজের ইচ্ছা থাকা সত্তেও মূলত তার স্ত্রীর আপত্তিতেই আর সন্তান নেয়া হয় নি।(তিন)স্বামীহারা নুরজাহান এই বাসার পুরাতন কাজের লোক। দুই মেয়েসহ নিজের সংসার সামলে রেহমান সাহেবের সংসারের যাবতীয় কাজ তাকেই করতে হয়। খুব অসুবিধা হলে বড় মেয়েটা তাকে সাহায্য করে। রেহমান সাহেবও তাদের নানাভাবে আর্থিক সহায়তা করে থাকে। মেয়ে দুটোকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন। স্কুলের যাবতীয় খরচ তিনিই বহন করেন।যদিও একাজ নুরজাহানকে একদম টানে না তবুও এই উর্ধমূল্যের বাজারে ঘর ভাড়া, থাকা-খাওয়া, মেয়ে দুটোর লেখাপড়াসহ যাবতীয় খরচের যোগান পাওয়া যাবে এমন কাজ সে আর কোথায় পাবে। নুরজাহান যেন ইতিহাসের সত্যিকারের মেহের-উন-নিসা। বাবা-মায়ের একমাত্র আদরের মেয়ে নুরজাহান ছোটবেলায় বেশ সুন্দরী এবং মেধাবী ছিলেন। বাবার অকাল মৃত্যুতে অভাবের সংসারে তার মায়ের পক্ষে আর লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিলো না। অনিচ্ছা সত্তেও তাই নানীর জোগাড় করা সুপুত্রের সাথে খুব অল্প বয়সেই বিয়ে হয় তার। ভালোই চলছিল সেই জীবন। কিন্তু বড় মেয়েটার বয়স যখন আড়াই বছর তখন আকস্মিক এক দুর্ঘটনায় মারা যায় সেও। নুরজাহান তখন আট মাসের পোয়াতি। ছোট মেয়েটা জন্মের পরই তার সুখের ঘরে বাড়তে থাকে অমানিশার ঘোর অন্ধকার। কাছের মানুষের অবহেলা আর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, বাধ্য হয়েই তাকে এই বিসর্জনের পথ বেছে নিতে হয়েছে। (চার)ফুলবানু নূরজাহানের দূরসম্পর্কের খালা। আগে এই বাসায় ছুটা বুয়ার কাজ করতো। ফুলবানুর সাহায্যেই নূরজাহান এ বাড়িতে কাজ পায়।বাসার সকল কাজের শিডিউল করে দেন মিস ফরিদা। নুরজাহানকেও তার নির্দেশনা মেনে চলতে হয়। ব্যস্ত থাকলেও রেহমান সাহেবের খাওয়া দাওয়ার সকল রুটিনও তিনিই করে দেন। নূরজাহানের উপর অনেকটাই নির্ভার থাকেন তিনি। নুরজাহানও সেই নির্ভরতার প্রতিদান দিয়ে যাচ্ছেন তার কাছ থেকে পাওয়া বাস্তব অভিজ্ঞতায়। নূরজাহানের অনুপস্থিতিতে তাই মিস ফরিদা বেশ বিপাকে পড়েছেন। টানা পাঁচ দিন ধরে তার আসার নাম নেই। তবে এতকিছুর পরেও নুরজাহান তার দ্বিতীয় নির্ভরতার নাম। প্রথমজন তার স্বামী রেহমান সাহেব। এক অচিন্ত বিশ্বাসের মূর্ত প্রতীক হিসাবে লালন করে চলেছেন তাকে। তবে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা তাকে কিছুটা সন্দেহবাদী করে তুলেছে। বিবাহিত জীবনের এত বছরে রেহমান সাহেবের ফোন সংক্রান্ত গোপনীয়তা কখনোই প্রাসঙ্গিকতা পায়নি মিস ফরিদার কাছে। অফিস কিংবা ব্যক্তিগত কোন কথাই আড়াল করতে দেখেননি ফরিদা। কিন্তু ইদানিং তিনি ফোন প্রায়ই সাথে সাথে রাখেন। মাঝে মাঝে কথা বলার সময় আড়ালে চলে যান। সন্দেহ\'র শুরু মূলত এখন থেকেই।ফুলবানুর বয়স হয়েছে , আগের মতো আর কাজ করতে পারেন না তবুও মিস ফরিদার খবর পেয়ে এসেছেন। নূরজাহানের কথা জিজ্ঞেস করাতে তিনি কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান। সামলে নিয়ে বলেন-গেরামে গ্যাচে, কি জরুরি কইলো। মনে ওয় জমিজমার মামলা। আইস্যা পরবো। আপনে চিন্তা কইরেন না ম্যাডাম।বুঝলাম কিন্তু ফোন বন্ধ কেন? পাল্টা প্রশ্ন করে মিস ফরিদা। মনে ওয় চার্জ গ্যাচে। গাউ-গেরামে কত সমস্যা! ফুলবানু হিসাব করে উত্তর দেয়। মিস ফরিদা কাজ বুঝিয়ে দিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পরে।(পাঁচ)ফুল আর মিষ্টি দেখে রেহমান সাহেবের মেজাজটা খিচড়ায়ে ওঠে। তবুও যথাসম্ভব গলার স্বর স্থির রেখে এগুলো নিয়ে যেতে বলেন। স্যার, আপনার সঠিক তদন্তের জন্যই এই রায় সম্ভব হয়েছে। আপনার জন্যই পরিবারের লোকজন সুষ্ঠু বিচার পেয়েছে। এই মহান কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ স্মৃতি হিসাবে একটা ছবি তুলে রাখতে চাই। অধস্তনের এহেন কান্ডে প্রচন্ড বিরক্ত হলেও অগত্যা ফটোশ্যুট প্রক্রিয়া শেষে তাকে বিদায় করেন।মিস ফরিদার মানবাধিকার সংগঠনের চেয়ারম্যানও একটা শুভেচ্ছা মেসেজ পাঠিয়েছেন। কিন্তু এসবে খুব মনোযোগ গেল না রেহমান সাহেবের। পরিচিত কেউ একজন বারবার ফোন দিচ্ছেন। ইচ্ছে করেই সেটাও ধরছেন না তিনি। আসলে সকাল থেকেই বেশ খানিকটা অস্থির হয়ে আছেন তিনি।ফোন করে ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলেন। ঘন্টা দুয়েক চলার পর একটা বেসরকারি হাসপালের সামনে এসে গাড়ি থামায় ড্রাইভার। ভিতরে একটা ছোট কেবিনে ঢোকে তারা।মেয়ের মাথার কাছে উল্টো দিকে ঝুকে বসে আছে নুরজাহান। ড্রাইভার ফুলের তোরা আর টাকার প্যাকেটটা বালিশের পাশে রেখে চলে যায়। কাঁধে হাত রাখতেই বুঝতে পারে নুরজাহান সেটা অতি পরিচিত কারো। এত দিনের ভরসা হয়ে ওঠা সে হাতের স্পর্শ আজ বড়ই তিক্ত মনে হয় তার কাছে। সে চোখ মুছে, আস্তে করে হাতটা নামিয়ে দেয়। সোজা ওঠে ঘুরে দাঁড়ায় রেহমান সাহেবের ঠিক চোখ বরাবর। রেহমান সাহেব খেয়াল করে তার চোখে আজ মায়া নেই, অসহায়ত্ব নেই। কেবল ঘৃণা আর নীরব ক্রোধ।রেহমান সাহেব আমতা আমতা করে-না মানে ফোন বন্ধ তাই ভাবলাম...হাত জোর করে নুরজাহান। টাকাগুলো নিয়ে যান দয়া করে, প্রায়শ্চিত্ত করতে দেন। আমার মেয়ের বাকি চিকিৎসাটুকু আমাকে করতে দেন-আহত কণ্ঠে অনুরোধ করে সে।কথা বাড়ান না রেহমান সাহেব, চুপচাপ বেরিয়ে আসেন।এখনও জ্ঞান ফেরেনি ময়নার। ডাক্তার বলেছে খুব পাওয়ারফুল ঘুমের ঔষধ, আরো ৬ ঘন্টার মতো লাগতে পারে। ধর্ষণের চেষ্টা হয়েছে। ব্লিডিং কমলেও এখনো শংকামুক্ত বলা যাচ্ছে না। ময়নার পাশে রাখা ফুলগুলোর দিকে তাকায় নুরজাহান। একটা অর্ধফোঁটা গোলাপে চোখ আটকে যায় তার, প্রস্ফুটিত হবার আগেই কেমন মলিন হয়ে যাচ্ছে। নুজাহানের মনে পরে তার ছোটবেলার কথা, স্কুলে সে পড়েছে -\"Life is not a bed of roses\'\' কাটার আঘাতে তাই বিদ্ধ হয়েছে তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায়। নিজ চোখে তাকে দেখতে হয়েছে স্খলিত জীবনের সাতকাহন। ফুলের সুবাস তাই তার কাছে হেরে যাওয়ার প্রারম্ভিক শর্ত। সে জানে এ অর্ঘ্য পূজার নয়, কেবলই বিসর্জনের।পৃথিবীর সকল স্বাভাবিক নিয়মই তার কাছে এখন অস্বাভাবিক মনে হয়। যে নিয়ম মিস ফরিদা পালন করেন শারীরিক সুস্থতার ধন্বন্তরি মন্ত্র হিসেবে সেটাই নুরজাহান কে করতে হয় বাধ্য হয়ে। দ্বিচারিতায় ঠাসা যে সমাজ, তার চোখে শুধুই ভ্রূকুটি আর লোলুপতার দৃষ্টি। নুরজাহানদের তাই আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয় সন্ধ্যার প্রদীপ হয়ে। এই গন্ডি পার করতে গেলেই তাদের পরিয়ে দেওয়া হয় অপবাদের ঘৃণ্য মুকুট, দাঁড় করিয়ে দেয় পাপীদের কাতারে। বিধাতার অমোঘ লিখন কে করিবে খণ্ডন? জীবনের নির্মম বাস্তবতায় নূরজাহান তাই সব মেনে নিয়েছে ভাগ্যদেবীর আশীর্বাদ হিসেবে। (ছয়)দুদিন হলো বাসায় ফিরেছে নুরজাহান। ময়নার অবস্থা আগের থেকেও খারাপ। কোনো ঔষধ খাওয়ানো যাচ্ছে না। ডাক্তার বলেছে, ওর ক্ষতিতা যতটা শারীরিক তার থেকেও বেশি মানসিক। ওর বয়সের মেয়েদের এই ট্রমা থেকে বের করে আনা কঠিন। যেকোনো মানুসিক চাপ ওর জন্য বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। চিকিৎসার খরচ মেটাতে স্বামীর একমাত্র স্মৃতি বালাজোড়া বিক্রি করে দিয়েছে নুরজাহান। সংসারের খরচ ছাড়াও প্রতিদিনের এত দামি দামি ঔষধের যোগান কিভাবে হবে এসব ভাবতে ভাবতে তন্দ্রামগ্ন হয়ে যায় সে। ছোট মেয়েটার চিৎকারে তন্দ্রা ভাঙে তার। এই কয়দিনের খাটাখাটনি আর অনিদ্রায় অনেকটাই ক্লান্ত নূরজাহানের হাত-পা যেন আর চলতে চায় না। তাছাড়া ঘরে তেমন কিছু নেই। মেঝেতে বসে পরে নুরজাহান।খানিক বাদে বাসায় আসে ফুলবানু। ময়নার খোঁজ নেয়।-চিন্তা করিস না। ডাক্তার তো কইছে কোনো ডর নাই। তাছাড়া ওর তো মাসিকও শুরু ওয় নাই এহনো।ছোট মেয়েটা এখনো কান্না করছে। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে নুরজাহান ঔষধ বের করে। সে আর ফুলবানু মিলে জোর করে ঔষধ খাওয়ায় কিন্তু ময়না রাখতে পারে না, বমি করে দেয়। রাগ সামলাতে পারে না নুরজাহান, টাস করে চড় মেরে বসে ময়নার গালে। আমার হয়েছে যত জ্বালা! খোদা মরণ দেয় না ক্যান?- কাঁদতে থাকে নুরজাহান।গভীর রাত, ময়নার গোঙানির শব্দে ঘুম ভাঙ্গে নূরজাহানের। ময়নার মুখের দিকে তাকিয়ে বুকটা ধুক করে ওঠে তার। ঠোঁটের কোনা বেয়ে ফেনা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে লালা। বা’পাশে রাখা হাতের চারপাশটা রক্তে ভিজে গেছে, হাতে সংযুক্ত কেনুলার নল বেয়ে এখনো গড়িয়ে পড়ছে কয়েক ফোটা তাজা রক্ত।অত্যহিত ভয়ে কেঁপে ওঠে তার অন্তরাত্মা।তটস্থ হাতে কোনোমতে কেনুলার ছিপি আটকে দেয় সে। কিন্তু ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। নিথর হয়ে যাওয়া ময়নার দেহটার সাড়া মিলছে না তাতে। নিষ্পাপ চোখজোড়া মায়া ছড়িয়ে তখনও তাকিয়ে আছে দৃষ্টিহীন। মুখটা বুকে গুঁজে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে নুরজাহান।রাতের অন্ধকার কাটতে শুরু করেছে। রাস্তার কাকগুলোর কা কা কানে বাজে নূরজাহানের। একজন দুইজন করে ভিড় জমে যায়। ফুলবানু আসে। বাড়িওয়ালা আর একজন মাওলানাকে সঙ্গে নিয়ে রেহমান সাহেবের ড্রাইভার আসে। বাড়িওয়ালা ফুলবানুকে ডেকে বলে লাশ বেশিক্ষন রাখা ঠিক না। মাওলানা সাব আছেন, দ্রুত দাফনের ব্যবস্থা করতে হবে। দাফন শেষে যে যার ঘরে ফিরে যায় , আস্তে আস্তে সূর্য পশ্চিমের কোলে ঢোলে পরে। অন্ধকার ঘরে বসে আছে নুরজাহান। মৃদু আলোয় টেবিলের উপর ঝুলানো ময়নার ছবিটা তখনও দেখা যাচ্ছে। একটু পর ঘরে ঢোকে ফুলবানু সঙ্গে মিস ফরিদা।(সাত)এয়ারপোর্টের দিকে যাচ্ছে রেহমান সাহেবের গাড়ি। গতরাতে তার ড্রাইভারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঝামেলা এড়াতে নিজের ব্যক্তিগত গাড়ি না নিয়ে উবারে চেপে বসেছেন তিনি। ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে আছে গাড়ি। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। পাশেই একটা ছেলে ছাতা উপরে তুলে একটা মেয়েকে(সম্ভবত গার্লফ্রেন্ড) বৃষ্টি থেকে বাঁচাবার খুব চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু মেয়েটি নাচার ভঙ্গিতে বৃষ্টি উপভোগ করছে। ছেলেটা একপর্যায়ে হাল ছেড়ে দেয়, নিজেও যোগ দেয় সেই উদযাপনে। ফরিদার কথা মনে হয় রেহমান সাহেবের। ফরিদাও খুব বৃষ্টি পছন্দ করত। এক শীতের রাতে বৃষ্টিতে ভিজে টানা সপ্তাহ জ্বরে ছিল সে।ফুটওভার ব্রিজের নিচে একটিইমাত্র টং দোকান। একটু আগে কাতরাতে কাতরাতে ভাত খাওয়ার জন্য টাকা চাওয়া বয়স্ক সাদা চুলের ভিক্ষুকটা সেখানে বসে বিড়ি টানছে।রেহমান সাহেব ঘামছেন, বেশ অস্থির লাগছে তার। তিনবার ড্রাইভারকে এসি বাড়াতে বলেও লাভ হয়নি।বুকের বাঁপাশটায় ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে। সিটে এলিয়ে পড়ছেন তিনি। অবস্থা বুঝতে পেরে ড্রাইভার জানতে চায়-স্যার, আপনার কি খারাপ লাগছে? হাসপাতালে নিয়ে যাবো?কোনো উত্তর দেন না রেহমান সাহেব। তার চোখ বুজে আসে। ঘোরের গহীনে ডুবতে থাকে তার জীবিত সত্তা। কানে বাজতে থাকে প্রতিবাদের তীব্র কণ্ঠস্বর-\'\'বিচার চাই, বিচার চাই \'\'। অস্পষ্ট সেই মুখগুলোর ভিড়ে তিনি স্পষ্ট দেখতে পান তার মেয়ে জান্নাতকে, উর্দ্ধগামী মুষ্টিবদ্ধ হাতে ময়নার পাশে দাঁড়িয়ে সেও স্লোগান দিচ্ছে -\'\'বিচার চাই, বিচার চাই \'\'।ময়নার নিষ্পাপ দুটি চোখ যেন জ্বলছে, বের হয়ে আসা আগুনের ফুলকি ক্রমাগত উল্কাপিণ্ডের মতো ধ্বংস করে যাচ্ছে তার দৃষ্টির শেষ শক্তিটুকুও।ড্রাইভার আবারও জানতে চায়-স্যার, হাসপাতালে নিয়ে যাবো? কোনো উত্তর আসেনা রেহমান সাহেবের কাছ থেকে। বারান্দায় নিস্পলক দাঁড়িয়ে আছে মিস ফরিদা। রাতে জ্বালিয়ে রাখা লাইটটা এখনো মাথার উপর মৃদু আলো ছড়িয়ে জ্বলছে প্রয়োজনহীন বাস্তবতার সাক্ষী হয়ে। একটু আগে চেয়ারম্যান বরাবরে দুটো মেইল করেছে সে। প্রথমটি ময়নার মামলার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য সংরক্ষিত একটা ভিডিও আর দ্বিতীয়টি তার পদত্যাগপত্র। বৃষ্টি ভারী হচ্ছে। বৃষ্টির পতনের ছন্দ সবসময় তার মনকে আলোড়িত করলেও সেই আলোড়নের ঢেউ আজকে নিস্প্রান,প্রতিটা ফোটা বৃষ্টি যেন এক একটা তীরের মতো বিদ্ধ করছে তার বুকের জমিন। বৃষ্টির পতন সরবে হলেও অশ্রুর পতন হয় নীরবে। তাকে তাই আড়ালেই রাখতে হয় সব সময়। তির্যকভাবে ছুতে আসা বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যেন সেই দায়িত্বই পালন করে যাচ্ছে, ভিজে ভিজে শীতল হচ্ছে দৃষ্টির আড়ালে থাকা সমস্ত মেঘরাশি।এক কোনায় পরে থাকা দৈনিক প্রত্রিকাটাও ভিজে যাচ্ছে। ডানদিকে বড় করে লেখা নিউজটা এখনো স্পষ্ট-আপিল বিভাগেও সাজা বহাল, দ্রুতই কার্যকর হচ্ছে ফাঁসি\'\'। অনিচ্ছা সত্তেও মিস ফরিদা কিছুটা পড়ার চেষ্টা করে-আলোচিত আছিয়া ধর্ষণ মামলা খারিজ করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। তিন সদস্যের তদন্ত প্রতিবেদন আর সাক্ষ্য প্রমানের ভিত্তিতে হাইকোর্টের দেয়া রায় ... আর পড়তে পারে না ফরিদা, তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
নুরজাহান যেন ইতিহাসের সত্যিকারের মেহের-উন-নিসা। বাবা-মায়ের একমাত্র আদরের মেয়ে নুরজাহান ছোটবেলায় বেশ সুন্দরী এবং মেধাবী ছিলেন। বাবার অকাল মৃত্যুতে অভাবের সংসারে তার মায়ের পক্ষে আর লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিলো না। অনিচ্ছা সত্তেও তাই নানীর জোগাড় করা সুপুত্রের সাথে খুব অল্প বয়সেই বিয়ে হয় তার। ভালোই চলছিল সেই জীবন। কিন্তু বড় মেয়েটার বয়স যখন আড়াই বছর তখন আকস্মিক এক দুর্ঘটনায় মারা যায় সেও। নুরজাহান তখন আট মাসের পোয়াতি। ছোট মেয়েটা জন্মের পরই তার সুখের ঘরে বাড়তে থাকে অমানিশার ঘোর অন্ধকার। কাছের মানুষের অবহেলা আর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, বাধ্য হয়েই তাকে এই বিসর্জনের পথ বেছে নিতে হয়েছে।
0 Comments