সিপনের জীবন ছিল খুবই সাধারণ। ঢাকার এক অফিসে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ, তারপর ক্লান্ত শরীর নিয়ে ট্রেনে বাড়ি ফেরা। ব্যস্ত শহরে হাজার মানুষের ভিড়ের ভেতরেও তার জীবনটা ছিল ফাঁকা, নিঃসঙ্গ।একদিন রাতের শেষ ট্রেনে ভিড় ঠেলতে ঠেলতে উঠছিল সিপন। হঠাৎ দেখল, সামনে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছে এক মেয়ে। হাত ভর্তি বই আর ব্যাগ মাটিতে ছড়িয়ে পড়ল। সিপন দ্রুত এগিয়ে গিয়ে মেয়েটাকে সামলে দিল, বইগুলো কুড়িয়ে দিল।মেয়েটি হেসে বলল——“ধন্যবাদ, না হলে বইগুলো ভিজে যেত।”সিপন উত্তর দিল——“ট্রেনে উঠতে গিয়ে পড়ে গেলে শুধু বই নয়, আপনিও ভিজে যেতেন।”দু’জনেই হেসে ফেলল। সেদিনই প্রথম পরিচয়—মেয়েটির নাম জান্নাত।এরপর আশ্চর্যভাবে প্রায়ই দেখা হতে লাগল শেষ ট্রেনেই। কখনও পাশাপাশি বসা, কখনও দাঁড়িয়ে থেকে দু’জনের মধ্যে ছোট ছোট আলাপ। সেই সাধারণ কথাবার্তাই ধীরে ধীরে হয়ে উঠল দিনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত।জান্নাত পড়াশোনা শেষ করে টিউশনি করত। তার স্বপ্ন ছিল নিজের একটা স্কুল করা, যেখানে দরিদ্র বাচ্চারা বিনা টাকায় পড়তে পারবে। সিপন মুগ্ধ হয়ে তার স্বপ্ন শোনত। নিজের ক্লান্ত জীবনের মাঝেও নতুন আলো খুঁজে পেত।এক রাতে প্রবল বৃষ্টির মধ্যে ট্রেন মাঝপথে থেমে গেল। চারপাশে অন্ধকার, জানালায় টুপটাপ বৃষ্টি। সিপন সাহস করে বলল——“জান্নাত, জানেন… এই শেষ ট্রেনটা যদি না থাকত, তাহলে হয়তো আপনাকেও চিনতাম না। আমার জীবনে আলোও আসত না।”জান্নাত কিছুক্ষণ চুপ থেকে আস্তে বলল——“সিপন, আমি সহজ না। আমার পরিবার খুব রক্ষণশীল। তারা চায় না আমি বাইরে টিউশনি করি, লেখাপড়াও তাদের চোখে তেমন গুরুত্বপূর্ণ না। আমি জানি না এই যাত্রাটা কতদূর চলবে।”সিপন গভীর চোখে তাকাল।—“তাহলে আমি প্রতিদিন এই শেষ ট্রেনেই বসে থাকব। একদিন যদি সবাই ছেড়ে দেয়, আমি তবু আপনাকে খুঁজে পাব।”এই কথাগুলো জান্নাতের হৃদয় ছুঁয়ে গেল। সেদিন প্রথম সে অনুভব করল, হয়তো তার স্বপ্নের মতোই কেউ আছে যে তাকে সত্যিই বুঝতে পারে।দিন কেটে যাচ্ছিল। তাদের সম্পর্কের গভীরতা বাড়ছিল, অথচ বাইরে থেকে কেউ জানত না। শহরের ব্যস্ততায় তারা খুঁজে নিত ছোট ছোট মুহূর্ত—কখনও চায়ের দোকানে, কখনও পুরনো বইয়ের বাজারে, কখনও স্রেফ রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে।একদিন জান্নাত হঠাৎ বলল——“সিপন, যদি আমি একদিন হঠাৎ চলে যাই? হয়তো পরিবার আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে, অথবা অন্য কোনো শহরে পাঠাবে।”সিপন জান্নাতের হাত ধরে বলল——“তাহলে আমি তোমার খোঁজে প্রতিদিন এই শেষ ট্রেনেই উঠব। তুমি না আসা পর্যন্ত নামব না।”জান্নাতের চোখে পানি চলে এল। সে বুঝল, ভালোবাসা মানে শুধু পাশে থাকা নয়, বরং প্রতিশ্রুতি—যা দূরত্ব আর সময়কেও হার মানায়।অবশেষে, অনেক বাধা-বিপত্তির পর জান্নাতের পরিবারও ধীরে ধীরে সিপনকে মেনে নিল। কারণ তারা দেখল, মেয়ের হাসি এখন শুধু এক নাম শুনলেই ফুটে ওঠে—সিপন।শেষমেশ সেই শেষ ট্রেনের যাত্রা আর কখনও শেষ হলো না। প্রতিদিনের ব্যস্ত শহর, ভিড় আর ক্লান্তির মাঝেও জান্নাত আর সিপন খুঁজে পেল নিজেদের একটুকরো শান্তির জানালা।আজও যখন তারা ট্রেনে চড়ে, একে অপরের হাত শক্ত করে ধরে থাকে। আর জান্নাত ফিসফিস করে বলে——“সিপন, মনে আছে? শেষ ট্রেনেই আমাদের গল্প শুরু হয়েছিল।”সিপন হেসে উত্তর দেয়——“হ্যাঁ, আর সেই জানালা আজও খোলা আছে।”
“শেষ ট্রেনের জানালা” হলো জান্নাত আর সিপনের একেবারে বাস্তব জীবনের মতো প্রেমের গল্প। ব্যস্ত শহরের ভিড়ের মাঝে রাতের শেষ ট্রেনে শুরু হওয়া এক ছোট্ট পরিচয় কিভাবে গভীর সম্পর্কে পরিণত হয়, সেই যাত্রার গল্প এটি। স্বপ্ন, সংগ্রাম, পরিবারিক বাধা—সবকিছুর মাঝেও ভালোবাসা কিভাবে নিজের জায়গা তৈরি করে নেয়, সেই সত্য আর মায়াবী কাহিনি।
0 Comments