সুজন একজন পরিশ্রমী গ্রামীণ কৃষক, ছোটবেলা থেকেই মাটির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রাখে। যুবক হয়ে লতা নামে সাহসী মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়, যে তার পাশে থাকে। বিয়ের পর ঋণ, ফসলের ক্ষতি ও দালালের চাপে তারা একে অপরকে সমর্থন করে। সুজন গ্রামের যুবক ও সমবায়ের সঙ্গে ঐক্য গড়ে তোলে। ধৈর্য্য, একতা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে তারা সংকট পেরিয়ে সফলতা অর্জন করে। গল্পে দেখানো হয়েছে আশা, সংগ্রাম ও মাটির সঙ্গে চিরন্তন সম্পর্কই জীবনের শক্তি।
📖 উপন্যাস : ধানের আশা
📖 উপন্যাস : ধানের আশা ✍️ লেখক: তুষার অধ্যায় ১: ধানের বীজ ভোরের আলো তখনো পুরোপুরি গ্রামকে ছুঁয়ে যায়নি। দূরে মসজিদ থেকে ফজরের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। শীতল বাতাসে কুয়াশার চাদর মাটিকে ঢেকে রেখেছে। কাদামাটি ভিজে আছে শিশিরে। গ্রামের মাটির পথ ধরে হাঁটছে একদল কৃষক—কাঁধে লাঙ্গল, হাতে কোদাল। এদের ভিড়ের মাঝেই ছোট্ট সুজন, বয়স তখন মাত্র দশ। তার বাবা রওশন আলী হাঁটতে হাঁটতে বললেন, — “সুজন, কৃষকের ছেলে হয়েছিস, তাই ধানগাছের গন্ধ যেন তোর বুকের ভেতরে ঢুকে থাকে। মাটি হলো আমাদের মা।” সুজন হাঁটার ফাঁকেই বাবার কথাগুলো গিলে নিচ্ছিল। শিশুসুলভ মনে অদ্ভুত এক স্বপ্ন জেগে উঠছিল—একদিন সে নিজেই বড় কৃষক হবে। ধানক্ষেতে পৌঁছেই সে থমকে গেল। ভোরের কুয়াশা ভেদ করে দিগন্ত জুড়ে সবুজ ধানের চারাগুলো দুলছে। বাতাসে ভেসে আসছে কাঁচা পাতার গন্ধ। সুজন ভাবল, এ যেন কোনো জাদুর পৃথিবী। বাবা যখন লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষ শুরু করলেন, সুজন ছোট্ট হাত দিয়ে মাটি কুড়িয়ে খেলছিল। সে খেয়াল করল, প্রতিটি মাটির দলার ভেতর লুকিয়ে আছে জীবনের বীজ। তখনো সে বুঝতে পারছিল না—এই বীজ শুধু গাছ নয়, ভবিষ্যতের গল্পও বয়ে আনে। দিন গড়িয়ে যায়। সুজনের শৈশব মানেই মাটি, ধানক্ষেত আর গ্রামের সরল জীবন। স্কুলে পড়াশোনা করার ফাঁকেই সে বাবার সঙ্গে মাঠে যেত। গরমের দিনে রোদ মাথার ওপর আগুনের মতো ঝরলেও বাবার কপালে ভাঁজ পড়ত না। আর বর্ষায় হাঁটু-সমান কাদায় দাঁড়িয়ে ধানের চারা রোপণ করতেন। একদিন বৃষ্টিভেজা দুপুরে সুজন জিজ্ঞেস করল, — “বাবা, এত কষ্ট করো কেন?” বাবা মুচকি হেসে উত্তর দিলেন, — “আমাদের কষ্টেই তো মানুষের ভাতের জোগান হয় রে বাবা। কৃষক না থাকলে কারো পাতে ভাত জুটত না।” সেই কথাগুলো সুজনের মনে গেঁথে গেল। রাত হলে মা প্রদীপ জ্বালাতেন। চারদিকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। মাটির ঘরে বসে মা সুজনকে গল্প শোনাতেন। কখনো কৃষকের সুখ-দুঃখ, কখনো স্বাধীনতার যুদ্ধের কাহিনি। আর প্রতিটি গল্প শেষে বলতেন, — “মাটি কখনো মিথ্যে বলে না, বাবা। মাটিতে পরিশ্রম করলে সে একদিন না একদিন ফেরত দেয়।” এইসব কথায় সুজনের ভেতর জন্ম নিচ্ছিল এক নতুন আশা, এক অদম্য বিশ্বাস। সে বুঝতে শুরু করল, কৃষকের জীবন কেবল কষ্ট নয়, এর ভেতরে লুকিয়ে আছে এক অমূল্য গর্বও। কিন্তু একই সাথে চারপাশে সে দেখছিল কৃষকদের দুঃখ-কষ্ট। এক প্রতিবেশীর ধানক্ষেত বন্যায় ভেসে গেল। আরেকজন চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ধান বুনেছিল, শেষে ধান বিক্রি করেও ঋণ শোধ করতে পারেনি। রাতে তাদের কান্নার শব্দ শোনা যেত। সুজনের মনে প্রশ্ন জাগত— “কেন কৃষক এত কষ্ট করেও ভালো থাকে না? কেন তাদের চোখে সবসময় চিন্তার ছাপ?” সে প্রশ্নের উত্তর তখনো জানত না। কিন্তু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল—বড় হয়ে সে শুধু কৃষক হবে না, কৃষকের জীবন বদলাবে। সেই ছোটবেলার ধানের গন্ধ, ভোরের কুয়াশা, বাবার কথাগুলো—সবই হয়ে গেল তার জীবনের প্রথম পাঠ। অধ্যায় ২: কাদামাটি ও খেলার মাঠ দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামছে। আকাশে রঙিন মেঘেরা ছড়িয়ে পড়েছে। চারদিকে মাঠ, পুকুর, তালগাছের সারি। গ্রামের বাচ্চারা একসাথে খেলার জন্য জড়ো হয়েছে। সেই ভিড়ের মধ্যে সুজনও আছে—হাত কাদা মেখে, চোখে দুষ্টু হাসি। আজ খেলা হবে “কাদার যুদ্ধ।” বৃষ্টির পরে মাঠ ভিজে আছে, জমে আছে জল। সবাই দৌড়াতে দৌড়াতে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছে কাদায়। মুখে নাক-মুখ ভর্তি কাদা হলেও তারা হাসতে হাসতেই উঠে দাঁড়াচ্ছে। সুজনের শৈশব মানেই এই কাদামাটি। তার কাছে এই মাটিই খেলার মাঠ, আবার শেখার জায়গা। বন্ধু কাবুল চেঁচিয়ে উঠল, — “এই দ্যাখ, আমি জিতবো!” দৌড়ে গিয়ে সে একটা কাদা দিয়ে বল তৈরি করে ছুঁড়ে মারল সুজনকে। সুজনও ছাড়ার পাত্র নয়। কাদা তুলে সোজা কাবুলের গায়ে ছুঁড়ে দিল। মুহূর্তেই মাঠ ভরে গেল হাসির শব্দে। শিশির নামের এক বন্ধু গম্ভীর হয়ে বলল, — “তোমরা সব কাদায় খেলে জামাকাপড় নষ্ট করছো, বাড়ি গেলে বকুনি খাবা।” সুজন হেসে উত্তর দিল, — “জামা ধোয়া যায়, কিন্তু মাটির গন্ধ কি ধোয়া যায়? এটা তো আমাদের রক্তে মিশে আছে।” সবাই থমকে গেল। ছোট্ট সুজনের মুখে এমন কথা শুনে বন্ধুরা অবাক হলো। কিন্তু সুজন সত্যিই অনুভব করত—এই মাটিই তার প্রাণ, তার অস্তিত্ব। খেলা শেষে সবাই মিলে পুকুরে ঝাঁপ দিল। জলে ডুব দিয়ে হাসাহাসি। গ্রামের সরল জীবন যেন কেবল মাটির গন্ধ আর পুকুরের জলে ভেসে থাকে। রাতে বাড়ি ফিরে সুজন দেখে, মা রান্নাঘরে ভাত বসাচ্ছেন। গরম ভাত, আলুভর্তা, পুকুরের মাছ ভাজা—এই সামান্য খাবারেই ছিল স্বর্গের সুখ। খাওয়া শেষে মা মৃদু হেসে বললেন, — “আজ আবার জামা কাদা করেছো?” সুজন লজ্জা পেয়ে উত্তর দিল, — “হ্যাঁ মা, কিন্তু খেলতে খুব মজা হয়েছে।” মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। — “যা-ই হোক, মনে রেখো বাবা, এই মাটিই আমাদের ভরসা। যার সঙ্গে খেলছো, সেই মাটিই একদিন তোর পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখবে।” সেই রাতে সুজন খোলা আকাশের নিচে শুয়ে ছিল। আকাশে ঝলমলে তারা। মাটির গন্ধ ভেসে আসছে বাতাসে। তার মনে হচ্ছিল, মাটি আর আকাশের মাঝেই সে জন্ম নিয়েছে, এখানেই তার জীবন গড়ে উঠবে। বন্ধুদের হাসি, খেলার মাঠ, মাটির স্পর্শ—সবকিছু তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল, জীবন যতই কঠিন হোক, এর সৌন্দর্য মাটি থেকেই আসে। অধ্যায় ৩: বাবার শিক্ষা ভোরবেলা। সূর্যের আলো উঠেছে, পাখিরা ডেকে যাচ্ছে গাছের ডালে। সুজন মাটির উঠোনে দাঁড়িয়ে বাবার পিছু পিছু মাঠের পথে হাঁটছে। কুয়াশার ভেতর দিয়ে হাঁটার সময় বাবার গলা থেকে ভেসে আসছে পুরোনো লোকসঙ্গীতের সুর— “ধান রে ধান, তুই দেশের প্রাণ…” সুজন অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকাল। তার মনে হলো, এই গান যেন শুধু গান নয়, এক ধরনের প্রার্থনা। মাঠে পৌঁছে বাবা লাঙ্গল ধরলেন। ঘেমে নেয়ে শরীর ক্লান্ত হলেও মুখে ছিল দৃঢ়তা। সুজন কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করল— — “বাবা, তুমি এত কষ্ট করো কেন? অন্য কাজ করলে হয় না?” রওশন আলী লাঙ্গল থামালেন। চোখে স্নিগ্ধ অথচ দৃঢ় দৃষ্টি। — “শোন সুজন, মানুষ পেট ভরে খায় কিসে?” — “ভাত দিয়ে।” — “আর ভাত আসে কোথা থেকে?” — “ধান থেকে।” — “তাহলে কৃষক ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারবে?” সুজন মাথা নাড়ল। — “না।” বাবা মাটিতে বসে সুজনকে কোলে নিলেন। — “কৃষকের কাজ সবচেয়ে কষ্টের, আবার সবচেয়ে গর্বেরও। আমরা মাটিতে বীজ ফেলি, ঘাম ঝরাই, তারপর সেই ধানেই লাখো মানুষের জীবন চলে। বুঝলি? কৃষক মানে শুধু শ্রমিক না, কৃষক মানে দেশের প্রাণ।” সুজন মুগ্ধ হয়ে বাবার মুখের দিকে তাকাল। ছোট্ট মনে গভীর কিছু ঢুকে গেল সেদিন। বাবা আবার বললেন, — “একটা কথা মনে রাখিস—এই মাটি কখনো প্রতারণা করে না। মাটি যেমন আছে, তেমনই ফেরত দেয়। পরিশ্রম করলে মাটি ফল দেয়, অলস হলে খালি থাকে। জীবনের নিয়মও তাই।” সুজন মাথা ঝাঁকাল। তার মনে হলো, এ যেন শুধু কৃষির শিক্ষা নয়, জীবনেরও শিক্ষা। সেদিন সন্ধ্যায়, কাজ শেষে বাবা ফিরে এলেন ক্লান্ত শরীরে। সুজন দৌড়ে গিয়ে পানি এনে দিল। বাবা হেসে বললেন, — “তুই আমার হাত ধরবি, একদিন আমার জায়গায় তুই দাঁড়াবি। আমি চাই, তুই শুধু কৃষক না, শিক্ষিত কৃষক হবি। যাতে তোকে কেউ ঠকাতে না পারে।” সুজনের বুক কেঁপে উঠল। সে প্রতিজ্ঞা করল, একদিন বাবার আশা পূরণ করবে। রাতে যখন মা ভাত পরিবেশন করছিলেন, বাবা নিঃশব্দে বললেন, — “কৃষকের কষ্ট হয়তো শেষ হবে না, কিন্তু কৃষকের সম্মান যেন কখনো হারিয়ে না যায়। সুজন, তুই সেই সম্মান রক্ষা করবি।” বাইরে তখন ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, আকাশে অসংখ্য তারা। সুজনের চোখের ভেতর সেই তারারা মিশে যাচ্ছিল বাবার কথার সঙ্গে। সেদিনের পর থেকে সুজন আর শুধু মাঠে খেলা করা ছেলে রইল না—সে হয়ে উঠল এক স্বপ্নবাজ কৃষকপুত্র। অধ্যায় ৪: ঝড়-বন্যার স্মৃতি গ্রীষ্মের তীব্র রোদ হঠাৎ একদিন মিলিয়ে গেল কালো মেঘের আড়ালে। বাতাস থমথমে, গাছপালা যেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গ্রামের মানুষরা বুঝতে পারল—বড় কিছু আসছে। বিকেলের দিকে আকাশে শুরু হলো বিদ্যুতের ঝলকানি, তারপর বজ্রপাত। মুহূর্তেই নেমে এলো ঝড়। হাওয়া এমন জোরে বইতে লাগল যে তালগাছগুলো দুলে উঠল, বাঁশবাগান ভেঙে পড়ল। সুজন তখন মায়ের আঁচলে লুকিয়ে ছিল। ঘরের চালের ফাঁক দিয়ে বৃষ্টির পানি ঢুকছে, ঘর কাঁপছে। বাইরে শোনা যাচ্ছিল মানুষের চিৎকার— — “ওরে বাঁচাও, ঘর ভেসে যাচ্ছে!” — “ধানের জমি শেষ হয়ে গেল!” রাতভর চলল ঝড়-বৃষ্টি। সকালে যখন ঝড় থামল, তখন দৃশ্যটা ছিল হৃদয়বিদারক। ধানের ক্ষেত ডুবে গেছে হাঁটু-সমান পানিতে। অনেক ঘর ভেসে গেছে। গরু-ছাগল কোথায় হারিয়ে গেছে কেউ জানে না। সুজন বাবার হাত ধরে মাঠে গেল। যে ক্ষেতটা কাল পর্যন্ত সবুজে ভরে ছিল, আজ সেখানে কেবল কাদাজল আর ভাসমান ধানের গাছ। বাবা নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর চোখের ভেতরে কান্না জমে উঠল, কিন্তু বাইরে প্রকাশ করলেন না। সুজন ছোট্ট গলায় জিজ্ঞেস করল, — “বাবা, সব ধান শেষ হয়ে গেল?” রওশন আলী ধীরে উত্তর দিলেন, — “হ্যাঁ বাবা, বন্যা সব নিয়ে গেল।” — “এখন আমরা খাব কী?” বাবা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, — “আল্লাহ বড়, উনি পথ বের করবেন। আমরা আবার চাষ করব।” কিন্তু ছোট্ট সুজন বুঝতে পারছিল, বাবার বুক ভেঙে যাচ্ছে। সন্ধ্যায় গ্রামে মোমবাতির আলোতে মানুষ জড়ো হলো। সবাই নিজেদের ক্ষতির কথা বলছে—কারো গরু ভেসে গেছে, কারো ধান নষ্ট, কারো ঘর ভেঙে পড়েছে। এক বৃদ্ধ কৃষক কাঁদতে কাঁদতে বললেন, — “আমরা কি জন্ম থেকে শুধু কষ্টের জন্যই জন্মেছি?” সুজনের বুক কেঁপে উঠল। শিশুমনে ভয় আর কষ্ট জমে গেল। কিন্তু তার মা লতার মতো করে কথা বললেন (তখনও লতা আসেনি, তবে মায়ের চরিত্র এভাবেই দাঁড়াচ্ছিল)— — “কান্না করে লাভ নেই। মাটি আমাদের থেকে যাবে। আবার ধান হবে।” সেই রাতে ক্ষুধার্ত পেটে শুয়ে ছিল সুজন। বাইরে এখনও বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছিল টুপটাপ করে। কিন্তু তার কানে বাজছিল বাবার কথা— \"আমরা আবার চাষ করব।\" এই বন্যা-ঝড়ই হয়ে উঠল সুজনের জীবনের প্রথম বড় শিক্ষা। সে বুঝল—কৃষকের জীবন কেবল আনন্দ নয়, এতে আছে ভয়ঙ্কর দুর্যোগের ছায়া। অধ্যায় ৫: কিশোর থেকে যুবক সময় বয়ে যায়। কুড়ি বছর আগের সেই কাদামাটি-মাখা ছেলেটি আজ বড় হয়েছে। সুজন এখন গ্রামের এক পরিচিত মুখ—লম্বা দেহ, ঘাম ঝরা কপাল, আর পরিশ্রমে খোদাই করা দৃষ্টি। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে সে কলেজ পর্যন্ত পড়েছে। বাবার স্বপ্ন ছিল—সুজন যেন কৃষক হয়, কিন্তু অশিক্ষিত কৃষক না; পড়াশোনা করেও যেন মাটির সঙ্গে সম্পর্ক না ভোলে। ক্লাসে বসে বন্ধুরা যখন চাকরি বা শহরে পড়াশোনার স্বপ্ন দেখত, সুজন তখন জানালার বাইরে তাকিয়ে ধানক্ষেত কল্পনা করত। তার মনে হতো, মাটির টান ছাড়া জীবন অসম্পূর্ণ। গ্রামে তখন এক অদ্ভুত সময়। অনেক তরুণ শহরে চলে যাচ্ছে। তারা বলছে— — “কৃষি করে আর চলা যায় না। শহরে গেলে চাকরি আছে, টাকা আছে, সুখ আছে।” সুজন কখনো ভাবত, হয়তো সত্যিই তাই। কিন্তু যখন সন্ধ্যায় মাঠে হাঁটত, বাতাসে দুলতে থাকা ধানগাছের শব্দ শুনত, তখন মনে হতো— \"শহর যতই আলো ঝলমলে হোক, মাটির গন্ধ কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না।\" বাবার শরীর ততদিনে দুর্বল হয়ে গেছে। লাঙ্গল হাতে আর আগের মতো শক্তি নেই। তাই জমির ভার আস্তে আস্তে সুজনের কাঁধে এসে পড়ল। একদিন মাঠে কাজ করতে গিয়ে বাবা ধীরে ধীরে বললেন, — “সুজন, আমি যতটা পারলাম করেছি। এখন তোর পালা। মনে রাখিস, কৃষি শুধু ফসল ফলানো নয়, কৃষি মানে ধৈর্য আর বিশ্বাস।” সেদিন সুজন মাথা নত করে বাবার পায়ের কাছে হাত রাখল। সে প্রতিজ্ঞা করল, মাটি ছেড়ে যাবে না। তবে তার ভেতরে এক প্রশ্ন সবসময় ঘুরপাক খেত— “আমি কি পারব এই কষ্টের জীবন টেনে নিতে? আমি কি পারব বাবার মতো ধৈর্য ধরতে?” সেই দোলাচলের ভেতরেই সুজনের যৌবন এগোতে লাগল। গ্রামের মেলায়, হাটে, খেলার মাঠে, কিংবা পুকুর পাড়ে তার সঙ্গে প্রায়ই দেখা হতো এক মেয়ের। নাম লতা। লতার চোখে ছিল অদ্ভুত এক দৃঢ়তা, যেন কষ্টের মাঝেও হাসতে জানে। প্রথম প্রথম কথা বলত লাজুকভাবে, পরে ধীরে ধীরে কথার আদান-প্রদান বাড়তে লাগল। একদিন গ্রামের মেলায় হঠাৎ বৃষ্টি নামল। সবাই দৌড়ে আশ্রয় নিল, কিন্তু সুজন আর লতা একই ছাউনির নিচে দাঁড়াল। ভিজে যাওয়া কপাল থেকে পানি মুছতে গিয়ে সুজন তাকাল লতার দিকে। মুহূর্তটা যেন জমে রইল সময়ের পাতায়। লতা হাসল, — “ধানের মতো তোমাদের জীবনও শুধু বৃষ্টি আর রোদে কাটে, তাই না?” সুজন অবাক হয়ে তাকাল। এতটা বোঝাপড়া কেউ আগে করেনি। সেদিন থেকেই লতা হয়ে উঠল সুজনের জীবনের নতুন স্বপ্ন। অধ্যায় ৬: লতার সঙ্গে দেখা মাঠের কাজ শেষ করে যখন সুজন হাটের পথে হাঁটে, তখন হঠাৎই চোখে পড়ে পরিচিত মুখ। লতা, গ্রামের স্কুলের মেয়ে, হাতে বই নিয়ে ফিরছিল। সেদিন প্রথমবার ঠিকমতো কথা হলো তাদের। লতা হেসে বলল— — “তুমি কি সবসময় কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকো? কখনো বিশ্রাম নাও না?” সুজন একটু লজ্জা পেয়ে উত্তর দিল— — “মাটির কাজেই তো আমার প্রাণ। বিশ্রাম তো পরে নেওয়া যাবে।” লতা মাথা নেড়ে হাসল। সেই হাসিতে এক অদ্ভুত টান ছিল। যেন সোনালি ধানের শীষ হাওয়ায় দুলছে। দিন গড়াল, দেখা হতে লাগল প্রায়ই। হাটে, খেলার মাঠে, কিংবা পুকুর পাড়ে। লতা সবসময় প্রাণবন্ত, চোখে স্বপ্ন, মুখে সাহসী কথা। একদিন সে বলল— — “কৃষি শুধু চাষ নয়, এটা একটা লড়াই। তোমার মতো তরুণদের যদি সবাই গ্রাম ছেড়ে যায়, তাহলে এই মাটির কী হবে?” সুজন বিস্ময়ে তাকাল। মনে মনে ভাবল— \"এই মেয়েটাই হয়তো আমার স্বপ্নকে বুঝবে।\" বছরের এক গ্রামীণ মেলায়, হঠাৎ বৃষ্টি নামল। সবাই দৌড়ে ছাউনির নিচে আশ্রয় নিল। সুজন আর লতা পাশাপাশি দাঁড়াল। বৃষ্টির ফোঁটা ঝরছিল ছাউনি ভেদ করে। লতা মৃদু হেসে বলল— — “ধানও তো এমন বৃষ্টিতে প্রাণ ফিরে পায়।” সেদিনের সেই বৃষ্টি যেন হৃদয়ের মাটিতে নতুন বীজ বপন করল। সুজন বুঝল, লতাকে ছাড়া তার ভবিষ্যৎ কল্পনা করা যায় না। অধ্যায় ৭: বিয়ের স্বপ্ন ও বাস্তবের সংগ্রাম লতার সঙ্গে সম্পর্ক গভীর হতে থাকল। গ্রামে সবাই একসময় বুঝতে পারল, দু’জনের চোখে চোখে কত অদ্ভুত বোঝাপড়া। লতার বাবা ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, সম্মানিত মানুষ। তিনি সুজনকে পছন্দ করতেন, তবে মনে এক ধরনের সংশয় ছিল— \"একজন কৃষক ছেলে কি আমার মেয়েকে সুখে রাখতে পারবে?\" সুজনও জানত, বিয়ে শুধু ভালোবাসা নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সংসারের খরচ, সামাজিক সম্মান আর ভবিষ্যতের নিরাপত্তা। কিন্তু তার মন বলত— \"যদি মাটিতে বীজ বপন করলে ফসল হয়, তবে জীবনে আশা বপন করলে সুখও জন্ম নেবে।\" বিয়ের প্রস্তাব এক সন্ধ্যায় সুজন সাহস করে লতার বাবার কাছে গেল। মাথা নিচু করে বলল— — “চাচা, আমি লতাকে বিয়ে করতে চাই। আমি জানি আমি ধনী নই, তবে আমার হাতের ঘাম দিয়ে আমি ওকে সুখে রাখব।” লতার বাবা চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন— — “সুজন, তোমার পরিশ্রম আমি জানি। কিন্তু আজকের দিনে শুধু ভালোবাসা দিয়ে সংসার চলে না। তোমার জমি কম, ঋণের বোঝা আছে। লতাকে কষ্ট পেতে আমি চাই না।” সুজনের বুক কেঁপে উঠল। কিন্তু লতা তখন ঘরে ঢুকে বলল— — “বাবা, কষ্টই তো জীবন। কষ্টে-সুখে যদি পাশে থাকার মানুষ থাকে, তবে সেই জীবনই আসল।” বাবার চোখ ভিজে উঠল। তিনি বুঝলেন, মেয়ের ইচ্ছার বিপরীতে দাঁড়ানো বৃথা। অবশেষে রাজি হলেন। বিয়ের আয়োজন গ্রামে ছোটখাটো আয়োজন হলো। সুজনের বন্ধুরা, প্রতিবেশীরা সবাই সাহায্য করল। বাঁশ কেটে মণ্ডপ বানানো হলো, ধানের খড় দিয়ে সাজানো হলো উঠোন। লতা লাল শাড়ি পরে যখন সুজনের পাশে বসলো, তখন মনে হচ্ছিল এ যেন ধানের মাঠে ফোটা লাল পলাশ। সেই রাতে সুজন মনে মনে শপথ নিল— \"যত কষ্টই আসুক, লতাকে আমি কখনো চোখের জল ফেলতে দেব না।\" বাস্তবের শুরু বিয়ের পরের দিনগুলো ছিল মধুর, কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই কষ্টের আসল রূপ প্রকাশ পেল। ধানের জমিতে বন্যার পানি উঠে গেল। ফসল প্রায় নষ্ট হয়ে গেল। বাজারে চালের দাম কম। ঋণ শোধের চাপ আবার মাথা চাড়া দিল। এক রাতে সুজন বসে আছে উঠোনে, হাতে ফসলের হিসাব। মুখ কালো করে বলল— — “লতা, মনে হয় এ বছর সব শেষ হয়ে যাবে।” লতা পাশে বসে তার হাত ধরে বলল— — “ধান আবার হবে, টাকা আবার আসবে। কিন্তু আমরা যদি হাল ছেড়ে দিই, তবে জীবন থেমে যাবে।” সেই কথাগুলো সুজনের ভেতরে নতুন আলো জ্বালালো। অধ্যায় ৮: নতুন সংগ্রামের পথে বিয়ের পরে জীবন নতুন চেহারা পেল। সুখের সঙ্গে এসেছে দায়িত্বের বোঝা। প্রতিটি দিন কেটে যায় জমি চষে, ফসলের খোঁজে, বাজারের দামের চিন্তায়। সুজন এখন শুধু কৃষক নয়, লতার স্বপ্ন পূরণের জন্য লড়াই করছে। ছোট্ট ঘরে সংসার শুরু হলেও ঋণের বোঝা তাকে বারবার কাঁপিয়ে দেয়। জমির জন্য ব্যাঙ্কে ঋণ নিয়েছে বাবা, সেই ঋণ শোধ করতে হবে। এক সকালে গ্রামের হাটে গিয়ে সে দেখল—ধানের দাম অস্বাভাবিক কম। দালালরা মুনাফা তুলছে, সাধারণ কৃষক পিছনে। সুজনের বুক ভারী হয়ে গেল। — “এত পরিশ্রম, এত ঘাম, অথচ আমার ফসলের মূল্য কেউ বুঝছে না?” লতা পাশে এসে বলল— — “তুমি একা নয়, আমরা একসঙ্গে লড়ব। ভয় পেও না।” সুজন বুঝল, লতার সাহসই তাকে শক্তি দিচ্ছে। দিনরাত সে নতুন পরিকল্পনা করতে লাগল—কিভাবে ফসলের সঠিক মূল্য পাবে, কিভাবে গ্রামের অন্যান্য কৃষককে একত্র করবে। এক বিকেলে তিনি হাটে মাইকে বললেন— — “বন্ধুরা, আমরা একত্র হলে দালালদের ঠকাতে পারি। আমাদের ফসলের দাম ন্যায্য করতে পারি। আজ থেকেই সবাই মিলে কাজ শুরু করি।” গ্রামের মানুষ অবাক হয়ে দেখল সুজনের দৃঢ়তা। তার চোখে শুধু নিজের জন্য নয়, সমগ্র গ্রামের জন্য লড়াই। পরের সপ্তাহে গ্রামের কিছু যুবক তার সঙ্গে যোগ দিল। তারা জমি বপন, বাজারে বিক্রি, নতুন কৃষি পদ্ধতি শিখতে শুরু করল। প্রথমদিনেই দেখা গেল—সহজ হবে না। কিন্তু সুজন আর লতা হাল ছাড়েননি। রাত হলে তারা দু’জনে উঠোনে বসে একে অপরের হাত ধরে বলল— — “যত কঠিনই হোক, আমরা একসঙ্গে। আমাদের আশা মাটির মতোই অটুট।” সেই রাতের আকাশে তারা লক্ষ করল—মাটি যেমন ছেঁড়া ঘামে ভরে যায়, তেমনি তাদের স্বপ্নও দিনে দিনে বড় হচ্ছে। অধ্যায় ৯: ঋণের জট ও পরিবারের সংগ্রাম জীবন যেন কখনো সহজ হয়নি। বিয়ের পর প্রথমবার ফসল বিক্রি করে ঋণের কিছুটা শোধ করার চেষ্টা করেও দেখা গেল, বাজারের দালালরা দাম কেটে নিচ্ছে। সুজনের মন খারাপ হলো। তিনি লতার হাতে হিসাবপত্র ধরিয়ে দেখালেন। — “লতা, আমরা যতই পরিশ্রম করি, সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। ঋণ তো কমছে না।” লতা হেসে বলল— — “হাল ছেড়ে দিও না। আমরা ছোট ছোট পদক্ষেপ নেব, ধীরে ধীরে সব ঠিক হবে।” তাদের সংসারে সুখ কমে, দায়িত্ব বেড়ে গেল। সন্তানদের পড়াশোনা, বাড়ির খাবারের খরচ, ঋণ শোধ—সব মিলিয়ে চাপ। লতা ঘরে সেলাই শুরু করল, ছোট ব্যবসা করার চেষ্টা করল। তারা একসাথে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত লড়াই করত। একদিন বাজারে গিয়ে সুজন দেখল, গ্রামের এক কৃষক আত্মহত্যা করেছে। ব্যাঙ্ক ঋণের বোঝা, ফসলের দাম কম—সব মিলিয়ে শেষ হয়ে গেছে তার। সুজনের বুক ভেঙে গেল। তিনি ভেবেছিলেন, শুধু নিজেদের জন্যই সংগ্রাম করব, কিন্তু দেখলেন সমগ্র গ্রামের জন্যই লড়াই প্রয়োজন। সেই রাতে সুজন বসে মনে মনে বলল— — “আমি কেবল পরিবারকে বাঁচাবো না, পুরো গ্রামের কৃষককে সাহায্য করব। আমাদের চেষ্টা ছাড়া কেউ কিছু দেবে না।” লতা পাশে বসে তার হাত ধরে বলল— — “আমরা একসঙ্গে আছি। ভয় পেও না। যত কঠিনই হোক, আমরা পারব।” পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ তারা গ্রামের যুবকদের সঙ্গে মিটিং করল। নতুন কৃষি পদ্ধতি, সমবায় চাষ, বাজারে বিক্রির পরিকল্পনা—সব শিখতে লাগল। সুজন বুঝতে পারল, শুধু মাটির সঙ্গে প্রেমই যথেষ্ট নয়; কৌশল, শিক্ষা আর নেতৃত্বও দরকার। রাত হলে তারা উঠোনে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল— — “ধান যেমন কষ্টে ফোটা দেয়, আমাদের জীবনও ঠিক তেমন হবে। আশা কখনো হারানো যাবে না।” অধ্যায় ১০: গ্রামের ঐক্য ও প্রথম সাফল্য সুজনের দৃঢ়তা ধীরে ধীরে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। তার সাহসিকতা দেখে অনেক যুবক তার সঙ্গে যোগ দিল। তারা সবাই মিলেই নতুন পরিকল্পনা করতে লাগল—কিভাবে ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা যায়, কিভাবে একসাথে চাষ ও বিক্রি করে দালালদের ঠেকানো যায়। প্রথম দিনেই দেখা গেল—সহজ হবে না। দালালরা আবার বাজারে দাপট দেখাচ্ছিল। কিন্তু সুজন হাল ছাড়ল না। লতা পাশে বসে বলল— — “যদি একা হতো, হয়তো হাল ছেড়ে দিতাম। কিন্তু আমরা সবাই একসঙ্গে, তাই পারব।” সুজন নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করল—ছোট জমিতে পরীক্ষামূলক ধান চাষ, সেচ ও সার ব্যবস্থার উন্নতি, এবং বাজারে সরাসরি বিক্রি। প্রথমবারের মতো ধানের কিছু অংশ বাজারে ভালো দামে বিক্রি হলো। গ্রামের মানুষ অবাক হয়ে দেখল—যে ফসল আগে কম দামে বিক্রি হতো, এবার ন্যায্য মূল্যে যাচ্ছে। ছোট ছোট লাভ হলেও সবাইকে আত্মবিশ্বাস জাগল। এক সন্ধ্যায় গ্রামের মাঠে বসে সবাই নিয়ে আলোচনা হলো। সুজন বলল— — “বন্ধুরা, আজ আমরা শুধু আমাদের জন্য নয়, সমগ্র গ্রামের জন্য লড়ছি। একসাথে থাকলে আমরা দালালদের ঠকাতে পারব, ফসলের মূল্য ন্যায্য করতে পারব।” সবাই হেসে উঠে, হাত মিলিয়ে বলল— — “ঠিক বলছো সুজন, আমরা একসঙ্গে থাকব।” সেদিন রাতের আকাশে তারা লক্ষ করল—মাটির মতোই তাদের আশা অটুট। সুজন বুঝল, সত্যিকারের সংগ্রাম কেবল নিজের জন্য নয়, সমগ্র সম্প্রদায়ের জন্য। লতা পাশে বসে হাত ধরে বলল— — “প্রথম ধানের মতোই আমাদের প্রচেষ্টা সফল হলো। আরও বড় স্বপ্ন দেখা যাক।” সেই রাত সুজনের মনে নতুন আশা জাগল। তিনি জানতেন, যতোই সমস্যা আসুক, তারা একসাথে থাকলেই জয় সম্ভব। অধ্যায় ১১: দালালের প্রতিশোধ ও বড় চ্যালেঞ্জ গ্রামের যুবকরা যখন নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছিল, তখন দালালরা তা লক্ষ্য করল। তারা বুঝতে পারল—সুজন ও গ্রামের মানুষদের ঐক্য তাদের জন্য বিপদসঙ্কেত। এক বিকেলে হাটে গিয়ে দালালের নেতা সুজনের সঙ্গে মুখোমুখি হলো। হেসে বলল— — “এই তো সাধারণ কৃষক ছেলে! ভাবছো তুমি আমাদের ঠকাতে পারবে?” সুজন নির্ভীকভাবে উত্তর দিল— — “আমি শুধু আমার জমির জন্য লড়ছি না। আমি আমার গ্রামের জন্য লড়ছি। আমরা একসাথে থাকলে কেউ আমাদের ঠকাতে পারবে না।” দালাল হেসে বলল— — “দেখব তোর হাল।” পরের সপ্তাহে দালালরা বাজারে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করল। ফসল কিনতে বাধা, ধান বিক্রি করতে সমস্যা, ঋণের হার আরও বাড়ানো—সবই পরিকল্পনা অনুযায়ী। সুজন বুঝল—এখন শুধু শ্রম নয়, কৌশল দরকার। তিনি গ্রামের যুবকদের সঙ্গে বৈঠক করল। — “আমাদের একত্রে থাকতে হবে। শুধু নিজের জন্য নয়, গ্রামের জন্য লড়তে হবে। আমাদের বিকল্প বাজার তৈরি করতে হবে, ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে।” লতা পাশে এসে বলল— — “তুমি হাল ছাড়ো না। আমি পাশে আছি।” সুজন গ্রামের যুবকদের নিয়ে নতুন সমবায় গঠন করল। প্রতিটি কৃষক নিজের ফসল সমবায়ে দিচ্ছে, বাজারে সরাসরি বিক্রি হচ্ছে। প্রথম দিনেই কিছু ক্ষতি এড়ানো গেল। এক রাতে সুজন লতার হাতে হাত ধরে বলল— — “দেখছো, একতা আমাদের শক্তি। দালাল যতই ছাপ ফেলুক, আমরা হারব না।” লতা হেসে বলল— — “যে যেমন ভয় দেখায়, আমরা ততই দৃঢ় হব।” গ্রামের মানুষ ধীরে ধীরে বুঝল—যদি একত্রে থাকে, দালালরা আর কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না। প্রথম বড় চ্যালেঞ্জে জয় হলো। সুজনের মনে দৃঢ় হল—এবার শুধু ফসল নয়, এই ঐক্য রক্ষা করাই হবে তার মূল লক্ষ্য। অধ্যায় ১২: সাফল্যের স্বপ্ন ও নতুন উদ্যোগ প্রথম বড় চ্যালেঞ্জ জয় করার পর গ্রামের মানুষ নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করল। সুজনের নেতৃত্বে সমবায় কার্যক্রম আরও মজবুত হলো। ফসলের বিক্রি এখন স্বচ্ছ, দালালের দাপট কমে গেছে। এক বিকেলে সুজন লতার সঙ্গে মাঠে হাঁটছিল। ধানের মাঠ লাল-সবুজ মিশে দুলছে। — “দেখছো লতা,” সুজন বলল, “এই সমবায় না হলে আমরা এতটা দূর আসতে পারতাম না।” লতা হেসে উত্তর দিল— — “সুজন, এটা আমাদের ছোট্ট সাফল্য। সামনে আরও বড় কাজ আছে। আমাদের লক্ষ্য শুধু নিজের পরিবার নয়, পুরো গ্রামের কৃষককে সাহায্য করা।” সুজন মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। তিনি নতুন পরিকল্পনা করল— 1. শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ: গ্রামের যুবক ও মহিলাদের নতুন কৃষি পদ্ধতি শেখানো। 2. বাজার সম্প্রসারণ: সমবায় ফসল সরাসরি শহরের বাজারে বিক্রি করা। 3. ঋণ মুক্তি: ব্যাঙ্ক ও ঋণদাতাদের সঙ্গে আলোচনা করে ঋণ কমানো। প্রথম ধাপে সফলতা এলো—কিছু যুবক ফসল চাষে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করল, খরচ কমে গেল। শহরের ক্রেতারা সমবায় থেকে সরাসরি ধান কিনতে শুরু করল। এক সন্ধ্যায় গ্রামের মানুষ মিলে মাঠে বসে আলোচনা করল। — “আমরা দেখতে পাচ্ছি, একতা ও পরিশ্রমেই সম্ভব। এবার সবাই মিলে আরও বড় উদ্যোগ নেওয়া যাক।” সুজন অনুভব করল, তার ছোট্ট স্বপ্ন—শুধু নিজের পরিবারের জন্য নয়, সমগ্র গ্রামের উন্নয়নের জন্য—ধীরে ধীরে বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। লতা পাশে এসে বলল— — “সুজন, আমাদের সংগ্রাম এখনই শেষ নয়। আমাদের আরও বড় স্বপ্ন দেখা দরকার।” সুজন তার হাতে হাত রেখে বলল— — “ঠিক বলেছো লতা, আমরা থামব না। আমাদের আশা, যেমন ধানের শীষ ফোটা দিয়ে আকাশে ছড়িয়ে যায়, তেমনি আমাদের স্বপ্নও ছড়িয়ে যাবে।” সেদিন রাতের আকাশে তারা দুইজন হাতে হাত রেখে মাটির দিকে তাকিয়ে বলল— \"এই মাটিই আমাদের জীবন, এই মাটিতেই জন্ম নেবে আমাদের আশা।\" অধ্যায় ১৩: দূর্যোগের সামনে দৃঢ়তা ও ধৈর্য্য পরীক্ষা সফলতার সেই সময়টি স্থায়ী হতে পারল না। একদিন হঠাৎ গ্রামের উপরে নেমে এলো ভয়ঙ্কর বন্যা। নদীর পানি বেড়ে ওঠে, ধানের মাঠ ডুবে যায়, বাঁশবাগান ভেঙে পড়ে। সুজন প্রথমে হতবাক। রাতভর হাটে এবং মাঠে গড়ে তুলা সমবায় ব্যবস্থা প্রায় সব ক্ষতিগ্রস্ত। গ্রামের মানুষ আতঙ্কিত। কেউ জানে না কীভাবে ঘর ও ফসল বাঁচানো যাবে। লতা পাশে এসে বলল— — “সুজন, ভয় পেও না। আমরা একসাথে আছি। এই ধৈর্য্যই আমাদের শক্তি।” সুজন মাথা নেড়ে বলল— — “ঠিক বলেছো। যত কষ্টই আসুক, আমরা হাল ছাড়ব না।” পরের দিন তারা গ্রামবাসীদের নিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করল। ভাসমান ফসল ও প্রাণী বাঁচানো, ঘর মেরামত করা, ক্ষতিগ্রস্ত জমিতে নতুন বীজ বপন—সব মিলিয়ে কঠিন পরিশ্রম। সুজন বুঝল—এই দূর্যোগ শুধু ক্ষতি নয়, এক ধরনের পরীক্ষা। পরীক্ষার লক্ষ্য: ধৈর্য্য, একতা ও বিশ্বাস। এক সপ্তাহ পর বৃষ্টি থামল। ক্ষতিগ্রস্ত জমি আবার চাষযোগ্য হলো। প্রথমে ক্ষুদ্র ফসল হলেও সুজন ও গ্রামের মানুষদের মনে আশা জন্মালো। রাত হলে লতা পাশে বসে বলল— — “দেখছো, এই দূর্যোগও আমাদের হারাতে পারেনি। আমরা আরও শক্তিশালী হয়েছি।” সুজন হাসল, চোখে জল। — “হ্যাঁ লতা, আমাদের সংগ্রাম শেষ হয়নি, কিন্তু আমরা শিখেছি—ধৈর্য্য আর ঐক্য থাকলে কোনো দূর্যোগও শেষ করতে পারে না। এই মাটিই আমাদের শিক্ষক, আমাদের শক্তি।” সেদিন রাতের আকাশে তারা দুজন বসে হাত ধরে বলল— \"যত কঠিনই জীবন হোক, আশা ও বিশ্বাসকে কখনো হারানো যাবে না।\" অধ্যায় ১৪: উন্নতি, স্বীকৃতি ও মাটির সঙ্গে চিরন্তন সম্পর্ক বন্যার ধ্বংস কাটিয়ে গ্রামের মানুষ আবার কাজে ফিরে এল। এবার সুজনের নেতৃত্বে সমবায় আরও শক্তিশালী হলো। নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার, সেচ ও সার ব্যবস্থার উন্নতি, বাজারে সরাসরি বিক্রি—সবই এখন নিয়মিত। গ্রামের মানুষ বুঝল, সুজন শুধু একজন কৃষক নয়, বরং তাদের নেতা, তাদের প্রেরণা। স্কুলে ও অন্যান্য সামাজিক জায়গায় তার নাম সম্মানজনক হয়ে উঠল। একদিন শহরের একটি কৃষি সংস্থা গ্রামে এল। তারা সুজনের উদ্যোগ দেখে প্রশংসা করল। সংস্থার প্রতিনিধি বলল— — “আপনি শুধু নিজের জন্য নয়, পুরো গ্রামের জন্য কাজ করছেন। আপনার মডেল অন্য গ্রামের জন্য অনুকরণীয়।” সুজন লাজুক হেসে বলল— — “আমি তো শুধু চেষ্টা করেছি। মাটি আমাদের শিক্ষক, আমাদের শক্তি।” লতা পাশে বসে বলল— — “তুমি মাটির সাথে চিরন্তন সম্পর্ক তৈরি করেছো। তুই শুধু ফসল চাষ করছো না, আশা চাষ করছো।” সুজন বুঝল, জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো এই—মাটি আর মানুষের মাঝে সম্পর্ক স্থাপন করা। শুধুই ধন বা সম্মান নয়, মানুষের সেবা ও আশা—এটাই সত্যিকারের সমৃদ্ধি। গ্রামের মাঠে দাঁড়িয়ে সে ধানের শীষের দিকে তাকাল। বাতাসে দুলছে সবুজ শীষ, সূর্যের আলো পড়ে ঝলমল করছে। সে মাটির দিকে মাথা নত করে বলল— — “আমার জীবন, আমার সংগ্রাম, আমার আশা—সবই তোমার জন্য, প্রিয় মাটি।” লতা হাসল, পাশে এসে হাত ধরে বলল— — “আমরা একসাথে এই মাটির গল্প লিখেছি, সুজন। জীবনের গল্প। আর গল্প শেষ হয় না।” সেদিন রাতের আকাশে তারা দুজন বসে হাত ধরে ভাবল— \"মাটি ও মানুষের সম্পর্ক, সংগ্রাম ও আশা—এটাই জীবনের সত্য।\" অধ্যায় ১৫: ভবিষ্যতের স্বপ্ন ও নতুন প্রজন্ম সুজন আর লতার জীবন এখন স্থির ও সুশৃঙ্খল। ফসল চাষ, বাজার, পরিবার—সবই সামলানো হচ্ছে নতুন পদ্ধতিতে। তবে তাদের মন শুধু বর্তমানেই আটকে নেই; তারা ভাবছে ভবিষ্যত, নতুন প্রজন্মের জন্য। একদিন সুজন তার ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে মাঠে গেল। ধানের শীষ দুলছে বাতাসে, মাটির গন্ধে ভরা সকাল। সে ছোট্ট বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে বলল— — “বাচ্চারা, দেখো এই মাটি। এটি শুধু খাবার দেয় না, এটি শেখায় পরিশ্রম, ধৈর্য্য আর আশা।” লতা পাশে এসে বলল— — “তোমাদের এই মাটির গল্প মনে রাখবে। আশা আর সংগ্রাম কখনো হারাবে না।” সুজন বুঝল, তার সংগ্রামের সত্যিকারের ফল এসেছে—শিশুরা দেখছে, শিখছে, এবং বুঝছে যে কষ্ট ও পরিশ্রম ছাড়া সুখ আসে না। গ্রামে নতুন উদ্যোগও চলছে—স্কুলে কৃষি শিক্ষা, যুবকদের প্রশিক্ষণ, নারীদের জন্য ক্ষুদ্র উদ্যোগ। সমবায়ের সংখ্যা বাড়ছে। ধানের শীষের মতোই নতুন আশা ফোটা দিচ্ছে প্রতিটি ঘরে। সন্ধ্যায় সুজন ও লতা হাত ধরে উঠোনে বসে আকাশের দিকে তাকাল। তারা জানত, এখনো অনেক দূর যেতে হবে, অনেক বাধা পেরোতে হবে। কিন্তু তারা ভেবেছে, একসাথে থাকার শক্তি কোনো দূর্যোগ বা সংকটকে হারাতে পারবে না। সুজন বলল— — “এই মাটি, এই গ্রাম, আমাদের সংগ্রাম। আমরা শুধু ফসল ফলাইনি, আমরা আশা বপন করেছি।” লতা হাসল, চোখে উজ্জ্বল আলো— — “তুমি ঠিক বলেছো, সুজন। আর আমরা আমাদের সন্তানদের সেই আশা দেখাব। তাদের জন্য আমরা পথ তৈরি করেছি।” রাতের আকাশে তারা দুজন বসে মাটির দিকে তাকিয়ে বলল— \"ধানের মতোই আমাদের স্বপ্ন ফোটুক, হাওয়ায় দুলুক, আর নতুন প্রজন্মের হাতে পৌঁছাক।\" এভাবেই সুজন ও লতার সংগ্রাম, আশা, এবং মাটির সঙ্গে চিরন্তন সম্পর্ক নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছালো।
0 Comments