“লাল দাগের ছায়া” একটি হৃদয়বিদারক উপন্যাস, যেখানে কারাগারের অন্ধকার দেয়ালের ভেতর থেকেও মানবিক সাহস, প্রতিবাদ, আর মুক্তির আলো ফুটে ওঠে।
📖 উপন্যাস : লাল দাগের ছায়া
📖 উপন্যাস : লাল দাগের ছায়া ✍️লেখক: তুষার অধ্যায় ১: বন্দিত্বের প্রথম প্রহর (বিস্তারিত) রিফাতের পা কাঁপছিল। সকাল হাওয়ায় ঠান্ডা লাগছিল না, কিন্তু তার ভিতরে এমন এক শীত যা শুধু শারীরিক নয়, বরং আত্মার ভিতর দিয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে। লোহার দোয়ারের গর্জন, প্রহরীর চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, এবং কারাগারের কাঁচের জানালার ছায়াময় আলো—সবই মনে করিয়ে দিচ্ছিল, সে এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন জায়গায়। প্রথমবারের মতো লোহার কক্ষে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে রিফাত অনুভব করল, এখানে সময়ের কোনো মানে নেই। ঘড়ির কাঁটা চলে, কিন্তু জীবনের কোনো গতিবেগ নেই। কোণে রাখা ফ্লোর ম্যাট, লোহার বিছানা, এবং দেয়ালের ছায়া—সবকিছু যেন নিস্তব্ধ। প্রথমবারের মতো তার চোখে ধরা দিল অন্যান্য বন্দিরা—কেউ চুপচাপ বসে আছে, কেউ ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে, আর কেউ যেন নিঃশব্দ অন্তর্মুখী যুদ্ধে লিপ্ত। মনে হলো, এখানে সময়ও স্তব্ধ। রিফাতকে ধীরে ধীরে ছোট কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। প্রহরী রানা বলল, “নতুন, এখানে সবকিছু নিয়মের অধীনে। ভুল করলে শাস্তি ভয়ঙ্কর।” রিফাত কাঁপল, কিন্তু নিজেকে বলল, “দেহ বন্দি হলেও, আত্মা কখনো নয়।” প্রথম রাতটি ছিল নিঃশব্দ ও একাকীত্বে পূর্ণ। রিফাত কোণে বসে মনে মনে ভাবল—মা-বাবার মুখ, বন্ধুদের হাসি, ঘরের বারান্দার রোদ। এই স্মৃতি তাকে কিছুটা শান্তি দেয়, কিন্তু ভয় আরও গভীর হয়। রিফাত প্রথমবার উপলব্ধি করল, এখানে প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত একটি পরীক্ষা। তাকে শুধু শারীরিক কষ্ট নয়, মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা\'র মধ্যেও দিয়ে যেতে হবে। সন্ধ্যার সময়, আরিফ নামের একজন বন্দি ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বলল, “নতুন? তুমি একা না। আমরা সাহায্য করব।” এই ছোট্ট শব্দগুলো রিফাতের মনে প্রথমবার শান্তি ও আস্থা দেয়। রিফাত জানল, এখানে ধৈর্য, বুদ্ধি এবং অন্তরের শক্তিই সবচেয়ে বড় অস্ত্র। প্রথম রাত কেটে যায়, নিঃশব্দে, ভয় ও নতুন জীবনের স্বপ্নের সংমিশ্রণে। অধ্যায় ২: নতুন পরিচয় ও প্রথম বন্ধুত্ব রিফাতের দ্বিতীয় দিনটি শুরু হলো ভোরের প্রথম আলোতে। কোঠার লোহার দরজা খুলে অন্য বন্দিদের সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়ানোর সময় তার মনে হলো, এখানকার প্রতিটি মানুষই যেন গল্পের অংশ—কেউ ভয়ঙ্কর, কেউ বন্ধুভাবাপন্ন, কেউ চুপচাপ। কোথায় বসা উচিত তা ঠিক করার সময় একজন ধীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “নতুন, নাম কী?” রিফাত উত্তর দিল, “রিফাত।” “আমি আরিফ। চিন্তা করো না, আমরা এখানে একে অপরের পাশে আছি।” আরিফের এই ছোট্ট বন্ধুত্বপূর্ণ স্বর রিফাতের ভেতরের ভয় কিছুটা কমিয়ে দেয়। আরিফ ধীরে ধীরে তাকে কারাগারের নিয়ম, খাবার সময়, বাথরুমের নিয়ম এবং কোন প্রহরী কতটা কঠোর—সব কিছু বোঝায়। প্রতিটি কথা যেন রিফাতকে নতুন শক্তি দেয়। সে বুঝতে পারে, এখানে শুধু শক্তি নয়, দৃষ্টি ও কৌশল প্রয়োজন। দিনভর রিফাত লক্ষ্য করে, বন্দিদের মধ্যে ছোট ছোট যুদ্ধ, ছোট ভুলের শাস্তি এবং কখনো কখনো বন্ধুত্বের আলোকছটা। কিছুদিনের মধ্যে রিফাত শিখতে শুরু করে—কখন কথা বলা উচিত, কখন চুপ থাকা উচিত, এবং কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করা যায়। সন্ধ্যায় কোঠার কোণে বসে রিফাত ভাবল, “এখানে জীবন কঠিন, কিন্তু ছোট ছোট বন্ধুত্ব, সাহায্যের হাত, এবং বুদ্ধি—এগুলোই বড় শক্তি।” প্রথম রাতের মতোই দ্বিতীয় রাতেও নিঃশব্দ ছিল। কিন্তু এবার ভয় আর একাকীত্বের সঙ্গে আশার আলোকছটা মিশে আছে। রিফাত বুঝতে পারে, কারাগারের প্রতিটি দিন শুধু শাস্তি নয়, এটি শিক্ষার ও বন্ধুত্বের স্থান। অধ্যায় ৩: প্রথম সংঘর্ষ ও নৈতিক পরীক্ষা রিফাতের তৃতীয় দিনটি শান্তির মুখ দেখেনি। সকালে খবর এলো, কারাগারের এক ব্লকে নতুন সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। রিফাতকে এই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার জন্য প্রহরী রানা নির্দেশ দিল। কোঠায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে চোখে পড়ল সেলিম—একজন বড় ও শক্তিশালী বন্দি, যার চোখে প্রথমবারেই রাগ ও শত্রুতার আগুন। সে বলল, “তুমি নতুন। ভুল করলে বুঝবি।” রিফাতের হৃদয় দ্রুত ধক্ধক্ করতে লাগল। সে বুঝল, এখানে শুধু দেহকে নয়, মনকে শক্ত রাখতে হবে। প্রথম সংঘর্ষে রিফাত কাঁপল। কিন্তু সে শিখল—শক্তি দেখানো সমাধান নয়। তার চেয়ে বড় শক্তি হলো ধৈর্য, বুদ্ধি এবং নৈতিকতা। সে শান্ত থাকল, এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। কয়েক দিনের মধ্যেই, সেলিম আচমকা রিফাতের কাছে এসে বলল, “তুমি সাহসী। আমরা বন্ধু হতে পারি।” রিফাত অবাক হয়। কারাগারের প্রথম শত্রু সত্যিই কি বন্ধুতে পরিণত হয়েছে? এই সম্পর্ক ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। সেলিম শিখল রিফাতের ন্যায়পরায়ণ মনোভাবের মানে, আর রিফাত শিখল—শত্রুর চোখেও যদি মানবিকতা থাকে, তবে বন্ধুত্বের সম্ভাবনা থাকে। রিফাতের কাছে এই দিনটি ছিল মধ্যবর্তী পরীক্ষা। সে উপলব্ধি করল, কারাগারে জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো—শক্তি নয়, নিষ্ঠা, বুদ্ধি এবং মানবিকতা বজায় রাখা। সন্ধ্যায় কোঠায় বসে রিফাত ভাবল, “যে শক্তি দেখায়, সেটি সঠিক নাও হতে পারে। সত্যিকারের শক্তি হলো, নিজের নৈতিকতা ধরে রাখা।” প্রথম সংঘর্ষ ও নৈতিক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে রিফাত বুঝল, তার জীবন এখন শুধুই দৃঢ় সংকল্প, বন্ধুত্ব ও ধৈর্যের পরীক্ষা। অধ্যায় ৪: ছোট্ট আনন্দের খোঁজ রিফাতের চারপাশে ভয়, অন্ধকার এবং নিঃশব্দ। প্রতিটি ঘন্টা যেন একই রুটিনে ছেঁকে ধরা—খাবার, শারীরিক অনুশীলন, এবং নিঃশব্দ পর্যবেক্ষণ। কিন্তু আজ সে খুঁজে পেল ছোট্ট আনন্দের সূচনা। সন্ধ্যার সময়, কোঠার কোণে বসে রিফাত একটি পুরনো বই খুলল। পাতার রং ফিকে, তবে গল্পগুলো তার মনে একটি আলোকছটা ফেলে। গল্পের নায়করা বিপদ, সংকট এবং দুর্দশার মধ্যেও আশা হারায় না—এটি রিফাতকে অনুপ্রাণিত করল। আরিফ হঠাৎ করেই গল্প শোনাতে শুরু করল। “এক সময় একটি ছোট্ট নৌকা বিশাল নদীতে ভেসে যায়… কিন্তু নৌকার মাঝি কখনো হাল ছাড়েনি। সে জানত, একদিন ঠিক সমুদ্রের নিরাপদ কোণে পৌঁছাবে।” রিফাতের চোখে অদ্ভুত উজ্জ্বলতা ফুটে উঠল। এই গল্পটি যেন তার নিজের জীবনের প্রতিচ্ছবি। কোথায় বসা, বই পড়া, আর বন্ধুর গল্প শোনা—এই ছোট্ট আনন্দের মুহূর্তগুলো রিফাতকে বুঝিয়ে দিল, যখন জীবন কঠিন হয়, তখন ছোট সুখই সবচেয়ে বড় শক্তি। তারপরও, রিফাত জানত—এই ছোট আনন্দ তাকে কিছুক্ষণ শান্তি দেবে, কিন্তু শিকার বা সমস্যার মুখোমুখি হতে হলে তার মানসিক দৃঢ়তা লাগবে। রাত হলে কোঠায় নিঃশব্দ নেমে আসে। রিফাত আর চিন্তা করে না শুধু নিজের কষ্ট নিয়ে। সে ভাবতে থাকে—যে আশা হারায় না, সে শক্তিশালী হয়। আজ থেকে সে ঠিক করল, ছোট ছোট মুহূর্তকেও শক্তি হিসেবে ব্যবহার করবে। এমনভাবে রিফাতের জীবন ধীরে ধীরে বদলাতে থাকে—ভয় থেকে আশা, একাকীত্ব থেকে বন্ধুত্ব, এবং হতাশা থেকে শক্তি। অধ্যায় ৫: প্রথম বড় পরীক্ষা রিফাতের কারাগারের পঞ্চম দিনটি শান্তির ছিল না। প্রহরী রানা কঠোরভাবে ঘোষণা করল, “যে কারও অনুশাসন ভাঙবে, শাস্তি ভয়ঙ্কর হবে।” রিফাত জানল, এটি শুধু একটি হুমকি নয়। প্রতিটি ছোট ভুলও বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। আজ তার বন্ধু আরিফের সাথে এক ছোট সমস্যা সমাধান করতে হবে—কিছু বন্দিকে শান্ত রাখা এবং নিয়ম শেখানো। প্রথমে ভয় পেলেও, রিফাত তার ধৈর্য ধরে রাখল। সে আরিফের সাথে কৌশল ভাবল—কোনও প্রহরীর নজর এড়িয়ে সমস্যার সমাধান করা। কিছু ঘণ্টার মধ্যেই তারা সফল হলো। প্রহরী রানা তাদের কাছে এসে বলল, “ভালো কাজ করেছ। মনে রেখো, বুদ্ধি আর ধৈর্যই এখানে সবচেয়ে বড় শক্তি।” রিফাত প্রথমবার উপলব্ধি করল—কারাগারের প্রতিটি দিন শুধু শাস্তি নয়, এটি শেখার, বন্ধুত্ব গড়ে তোলার এবং ধৈর্য ধারণের পরীক্ষা। তিনি বুঝলেন, শক্তি সবসময় সমাধান নয়। বুদ্ধি, ন্যায়পরায়ণ মনোভাব এবং বন্ধুত্বই সবচেয়ে বড় অস্ত্র। সন্ধ্যার সময় রিফাত কোঠার কোণে বসে ভাবল, “আমি যতই কষ্ট পাই, হাল ছাড়ব না। প্রতিটি পরীক্ষা আমাকে আরও শক্তিশালী করছে।” আজ থেকে রিফাতের জন্য কারাগার শুধু শাস্তির স্থান নয়—এটি মানসিক শক্তি, বন্ধুত্ব এবং নৈতিকতা শেখার স্থান। অধ্যায় ৬: কারাগারের নিয়মকানুন রিফাতের ষষ্ঠ দিনটি শুরু হলো ভোরের আলোয়। প্রতিটি কক্ষের লোহার দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে তাকে মনে হলো, এখানে সময় থেমে আছে। ঘড়ির কাঁটা চলে, কিন্তু জীবন যেন স্থবির। প্রহরীরা চোখে চোখ রাখে। একটি ভুল চোখের দৃষ্টি বা শব্দের কারণে শাস্তি ভয়ঙ্কর হতে পারে। আজ রিফাত শিখবে—শৃঙ্খলা মানার গুরুত্ব এবং নিজের কৌশল বজায় রাখার কলা। আরিফ ধীরে ধীরে বোঝাল— “রিফাত, এখানে কোন প্রহরী কেমন, কোন মুহূর্তে রাগ দেখাবে, তা বোঝা জরুরি। ভুল করলে শুধু দেহ নয়, আত্মাও আহত হয়।” রিফাত লক্ষ্য করতে শুরু করল— কোন বন্দি কখনো চুপচাপ, কখনো আক্রমণাত্মক খাবারের সময়ে ছোট ছোট নিয়ম লঙ্ঘন হলে শাস্তি শারীরিক অনুশীলন ও সময়ানুবর্তিতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ প্রথমবারের মতো সে বুঝল, কারাগারের নিয়ম শুধু শাস্তি নয়, এটি জীবনের কৌশল শেখায়। দুপুরে, রিফাত প্রহরীর কাছ থেকে শিখল, কখন কোন কাজ করা উচিত, কোথায় সতর্ক থাকা প্রয়োজন, এবং কোন মুহূর্তে চুপ থাকা ভালো। এই পাঠ তাকে শিখিয়েছে—শক্তি নয়, বুদ্ধি এবং ধৈর্যই বড় অস্ত্র। সন্ধ্যায় রিফাত কোঠায় বসে ভাবল, “এখানে জীবন কঠিন, কিন্তু শৃঙ্খলা ও কৌশল আমাকে আরও শক্তিশালী করছে। প্রতিটি নিয়ম মানলেই আমি একটু স্বাধীন বোধ করতে পারি।” রিফাত উপলব্ধি করল—কারাগারের প্রতিটি দিন শুধু শাস্তি নয়, এটি শেখার, কৌশল শিখার এবং ধৈর্য অর্জনের স্থান। অধ্যায় ৭: বন্ধুত্বের ছায়া কারাগারের সপ্তম দিনটি ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে একটু আলাদা। রিফাত ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করল, এখানে শুধু শৃঙ্খলা বা কৌশল নয়—মানুষের সম্পর্কই সবচেয়ে বড় শক্তি। সেলিম, যে প্রথমে তার শত্রু ছিল, আজ তার পাশে দাঁড়ালো। দুজন একসাথে খেতে গেল, কোঠায় বসে নিঃশব্দে গল্প করল। সেলিম বলল, “রিফাত, এখানে কেউ একা টিকে থাকতে পারে না। যারা একে অপরকে সাহায্য করে, শুধু তারাই শক্তিশালী।” রিফাত অনুভব করল, বন্ধুত্ব মানে কেবল হাসি বা গল্প নয়। এটি হলো বিশ্বাস, সহমর্মিতা এবং বিপদের সময় একে অপরের পাশে থাকা। বৃহস্পতিবার বিকেলে তারা একসাথে কয়েকজন নবাগত বন্দির সমস্যার সমাধান করল। রিফাত প্রথমবার বুঝল, শক্তি সবসময় সমাধান নয় বুদ্ধি ও ধৈর্য দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যায় বন্ধুত্ব এবং সমর্থন সবচেয়ে বড় অস্ত্র সন্ধ্যার কোণে বসে রিফাত ভাবল, “সেলিমের সঙ্গে এই বন্ধুত্ব শুধু সুবিধার জন্য নয়, এটি আমাকে শেখাচ্ছে কীভাবে মানবিক হওয়া যায়, এবং কীভাবে বিপদের সময় শান্ত থাকতে হয়।” কারাগারের কঠিন পরিবেশেও এই বন্ধুত্ব রিফাতকে সাহস ও আশা দিচ্ছে। তিনি জানল, একটি বিশ্বাসযোগ্য বন্ধু জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তি হতে পারে। অধ্যায় ৮: প্রথম বিপর্যয় রিফাতের অষ্টম দিনটি শুরু হলো ভোরের নিঃশব্দে। কিন্তু শান্তি স্থায়ী হয়নি। কারাগারের অন্য ব্লকে হঠাৎ হট্টগোল শুরু হলো। বন্দিরা একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। রিফাত প্রথমে ভয় পেল। তার হৃদয় দ্রুত ধক্ধক্ করতে লাগল। সে জানল, ছোট ভুলও বড় বিপদের কারণ হতে পারে। আরিফ পাশে দাঁড়াল, এবং শান্ত কণ্ঠে বলল, “রিফাত, এখনই আমাদের বুদ্ধি ও ধৈর্য পরীক্ষা হবে। একসাথে কাজ করতে হবে।” সেলিমও তাদের পাশে হাজির হলো। তারা তিনজন মিলে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করল। ধৈর্য ধরে ধাপে ধাপে তারা কিছু বন্দিকে শান্ত করল, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনল। রিফাত প্রথমবার উপলব্ধি করল—শক্তি দেখালেই সব সমাধান হয় না। বুদ্ধি, ধৈর্য এবং একে অপরের সমর্থন প্রয়োজন। বিপর্যয় কাটিয়ে তারা কোঠায় ফিরে এল। রিফাতের শরীর ক্লান্ত, কিন্তু মন শক্ত। সে জানল, জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা কখনও শান্ত সময়ে আসে না; এটি আসে বিপদের মুহূর্তে। সন্ধ্যার আলোয়, কোণে বসে রিফাত ভাবল, “প্রথম বিপর্যয় আমাকে শিখিয়েছে—ভয়কে কৌশল ও সাহস দিয়ে মোকাবেলা করতে হয়। এবং বন্ধুর পাশে থাকা সবচেয়ে বড় শক্তি।” আজ থেকে রিফাতের জীবন আর আগের মতো নয়। এখন তার মনে শক্তি, ধৈর্য, বন্ধুত্ব এবং ন্যায়বোধ—চারটি মূলস্তম্ভ তৈরি হয়েছে। অধ্যায় ৯: অন্তর্মুখী যাত্রা রিফাতের নবম দিনটি ধীরে ধীরে শেষের দিকে এগোচ্ছে। কোঠার কোণে বসে সে নিজের জীবনের ছায়ায় ডুবে যায়। চারপাশের নিঃশব্দতা তাকে আরও গভীরভাবে ভেতরের দিকে ধাবিত করে। মায়ের মুখের উষ্ণ হাসি, ছোট শহরের রোদেলা সকাল, বন্ধুরা একসাথে খেলা—সব স্মৃতি তার মনে প্রবাহিত হয়। প্রতিটি স্মৃতি তাকে মানবিক শক্তি এবং সাহস দেয়। রিফাত বুঝতে শুরু করে, কারাগারের প্রতিটি দিন শুধুই শাস্তি নয়। এটি একটি ভেতরের শিক্ষার স্থান। প্রতিটি বিপদ, প্রতিটি ছোট আনন্দ, প্রতিটি সম্পর্ক—সবই তার আত্মাকে গঠন করছে। সে লিখে রাখে ছোট্ট কাগজে— জীবন কঠিন হলেও আশা হারাতে হবে না বন্ধুত্ব ও মানবিক সম্পর্কই সবচেয়ে বড় শক্তি ধৈর্য ও বুদ্ধিই সবচেয়ে মূল্যবান অস্ত্র সেলিম এসে তার পাশে বসে বলল, “রিফাত, আজকে তুমি যা ভেবেছ, তা শিখলে—যেকোনও বিপদ সামলানো যাবে।” রিফাত বোঝে, কারাগারের শারীরিক সীমাবদ্ধতার বাইরে ভেতরের স্বাধীনতা অটুট। রাত হয়। রিফাত জানালার পাশে বসে আকাশের দিকে তাকায়। তার মনে আসে—মুক্তি শুধু দেহের নয়, মন ও আত্মারও। সে সিদ্ধান্ত নেয়, প্রতিটি দিনকে জীবনের শিক্ষার অংশ হিসেবে গ্রহণ করবে। আজ থেকে রিফাত আরও দৃঢ়, আরও সতর্ক এবং আরও মানবিক। তার অন্তর্মুখী যাত্রা তাকে শিখিয়েছে—ভয়কে মোকাবেলা করতে সাহস, দুর্দশাকে মোকাবেলা করতে ধৈর্য, এবং একে অপরকে সাহায্য করতে মানবিকতা প্রয়োজন। অধ্যায় ১০: ন্যায়ের খোঁজ দশম দিনটি রিফাতের জন্য বিশেষ এক দিন। কারাগারের এক কোণে ছোট কিছু বন্দি অবিচারের শিকার হচ্ছিল। প্রহরীরা বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করছিল, আর কিছু শক্তিশালী বন্দি পরিস্থিতি আরও উত্তেজিত করছে। রিফাতের ভেতরে এক অদ্ভুত অগ্নি জ্বলে ওঠে। সে জানল, এখানে ন্যায় শুধুই প্রত্যাশা নয়, এটি অর্জন করার সংগ্রাম। সেলিম এবং আরিফের সঙ্গে সে ধীরে ধীরে পরিকল্পনা করল। শান্তভাবে বন্দিদের বোঝানো প্রহরীদের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা আক্রমণাত্মক বন্দিদের বুদ্ধি ও কৌশলে প্রশমিত করা কয়েক ঘন্টা পর পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলো। প্রহরী রানা আসে এবং বলে, “ভালো কাজ করেছ। এখানে সাহস ও বুদ্ধির মিশ্রণই ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে।” রিফাত প্রথমবার উপলব্ধি করল—ন্যায় রক্ষা করতে হলে সাহসী হতে হবে, কিন্তু বুদ্ধি ও ধৈর্য দিয়ে কাজ করতে হবে। সন্ধ্যায় কোঠায় বসে রিফাত ভাবল, “আমরা শুধু নিজের জন্য নয়, অন্যের জন্যও লড়তে পারি। ন্যায় মানে শক্তি নয়, চেতনা এবং মনোবল।” আজ থেকে রিফাতের মানসিক জগত আরও প্রসারিত হলো। সে জানল, কারাগারের কঠোর নিয়মকানুন ও বিপদেও ন্যায়ের জন্য লড়াই করা সম্ভব, যদি সাহস, বুদ্ধি এবং মানবিকতা একসাথে থাকে। অধ্যায় ১১: একাকীত্বের রাত রিফাতের এগারতম দিনটি শেষের দিকে এগোচ্ছে। কোঠার লোহার দরজা বন্ধ হলে নিঃশব্দ চারপাশে নেমে আসে। হঠাৎ, এক অদ্ভুত শূন্যতার অনুভূতি তার মধ্যে ঘুলতে থাকে—এ যেন একাকীত্বের গভীর অরণ্য। সন্ধ্যার আলো ম্লান, এবং প্রতিটি শব্দ—প্রহরীর পদক্ষেপ, অন্য বন্দিদের নিঃশব্দ নিঃশ্বাস—রিফাতের কানে যেন আরও প্রতিধ্বনিত হয়। সে কোণের বিছানায় বসে ভাবতে থাকে। মনে পড়ে মা-বাবার মুখ, ছোট শহরের রোদ, বন্ধুর হাসি। এই স্মৃতি তাকে শান্তি দেয়, কিন্তু একাকীত্বের ছায়া আরও গভীর। রিফাত উপলব্ধি করে—একাকীত্ব শুধুই শারীরিক নয়, এটি মানসিক ও আত্মিক পরীক্ষাও। তিনি বুঝতে পারেন, একা থাকা মানে নিজের ভেতরের শক্তিকে চেনা। রাতভর রিফাত লিখে রাখে— ভয়কে ভয় না মেনে ধৈর্য ধরতে হবে প্রত্যেকটি কঠিন মুহূর্ত মানসিক শক্তি বাড়ায় একাকীত্বের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায় প্রহরীর পদক্ষেপ দূরে চলে গেলে, রিফাত জানালার পাশে বসে আকাশের দিকে তাকায়। তার মনে হয়, আকাশের অসীমতা তার মানসিক একাকীত্বকেও প্রশস্ত করে দিচ্ছে। এই রাত রিফাতকে শিখিয়েছে—যখন জীবন কঠিন, একাকীত্বও শক্তির উৎস হতে পারে। এবং ভেতরের দৃঢ়তা বজায় রাখলেই বিপদ মোকাবেলা করা যায়। অধ্যায় ১২: নতুন চ্যালেঞ্জ রিফাতের বারোতম দিনটি শুরু হলো ভোরের হালকা রোদে। কিন্তু আজ শান্তি অপেক্ষা করছে না। কারাগারের অন্য ব্লকে হঠাৎ বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা শুরু হলো। কিছু শক্তিশালী বন্দি নতুন বন্দিদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। রিফাত জানল, এই পরিস্থিতি শুধু তার বুদ্ধি নয়, ধৈর্য ও সাহস পরীক্ষা করবে। আরিফ এবং সেলিমকে সঙ্গে নিয়ে সে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করল। তিনজন মিলে পরিকল্পনা করল— নবাগতদের শান্ত রাখা উত্তেজিত বন্দিদের সর্তক করা প্রহরীর নজর এড়িয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তারা পরিস্থিতি স্থিতিশীল করল। প্রহরী রানা কাছে এসে বলল, “ভালো কাজ করেছ। যারা বুদ্ধি, ধৈর্য এবং সাহস মিলিয়ে কাজ করে, তারা বড় বিপদও সামলাতে পারে।” রিফাত প্রথমবার উপলব্ধি করল—শক্তি বা আগ্রাসন সবসময় সমাধান নয়। বুদ্ধি, একতা এবং সঠিক সময়ে পদক্ষেপই বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার চাবিকাঠি। সন্ধ্যার আলো নেমে আসলে রিফাত কোঠায় বসে ভাবল, “আজকের চ্যালেঞ্জ আমাকে আরও শক্তিশালী করেছে। জীবনের যেকোনও বিপদ ধৈর্য, বন্ধুত্ব এবং বুদ্ধি দিয়ে মোকাবেলা করা যায়।” এই দিনটি রিফাতকে শিখিয়েছে—কারাগারের প্রতিটি মুহূর্ত শুধু শাস্তি নয়, এটি মানসিক ও নৈতিক শক্তি অর্জনের সুযোগ। অধ্যায় ১৩: প্রত্যয়ের আলোকছটা রিফাতের ত্রয়োদশ দিনটি শুরু হলো ভোরের প্রথম আলোয়। লোহার দোয়ারা খোলার সঙ্গে সঙ্গে সে অনুভব করল, আজ যেন কিছু ভিন্ন। ভেতরের অন্ধকারের মাঝে এক আলোকছটা বিস্তৃত হচ্ছে। সেলিম এবং আরিফ পাশে এসে বলল, “রিফাত, তুমি দেখছ না? আমরা কতটুকু এগিয়েছি। এখানে শুধু কষ্ট নয়, আশা ও শক্তিও আছে।” রিফাত বুঝল, কারাগারের প্রতিটি দিন তাকে শুধু শাস্তি দেয়নি। এটি ধৈর্য, বুদ্ধি, মানবিকতা এবং শক্তির শিক্ষা দিয়েছে। প্রতিটি ছোট বিজয়, প্রতিটি বন্ধু, প্রতিটি উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্ত—সবই তাকে আরও দৃঢ় করেছে। কোণায় বসে রিফাত লিখল— বিপদ মানেই হতাশা নয় আশা মানেই শক্তি প্রতিটি দিন নতুন শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে আসে সন্ধ্যার আলো নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে রিফাত জানালার দিকে তাকাল। আকাশের নীলচ্ছায়া মনে করিয়ে দিল—যে যাত্রা কঠিন, তার শেষে আলোকিত সুযোগ অপেক্ষা করে। রিফাতের মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্ম নিল—যে ভয়কে সাহস, হতাশাকে আশা, এবং একাকীত্বকে শক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে শিখেছে, সে যে কোনো বাধা অতিক্রম করতে পারে। আজ থেকে রিফাত শুধু বাঁচছে না, তিনি শিখছে, শক্তিশালী হচ্ছে এবং তার জীবনের লক্ষ্য স্পষ্ট করছে। অধ্যায় ১৪: বিপদের প্রহর রিফাতের চতুর্দশ দিনটি শুরু হলো ভোরের নিঃশব্দে। আজ কারাগারের পরিবেশে এক অদ্ভুত চাপ অনুভূত হলো। কিছু শক্তিশালী বন্দি নতুন বন্দিদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে চাচ্ছিল। প্রহরীরা তখন অন্য ব্লকে ব্যস্ত। রিফাত জানল, এখনই তার ধৈর্য ও বুদ্ধি পরীক্ষা হবে। সে সেলিম ও আরিফকে পাশে ডেকে সমস্যার সমাধান করার পরিকল্পনা করল। নবাগতদের শান্ত রাখা উত্তেজিত বন্দিদের সর্তক করা প্রহরীর নজর এড়িয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা কয়েক ঘন্টা চলে, এবং পরিস্থিতি ক্রমে নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে রিফাতের হৃদয় এখনও উত্তেজিত। সে জানল, বিপদ কখনো শেষ হয় না, কিন্তু ধৈর্য, বুদ্ধি এবং বন্ধুত্ব দিয়ে তা মোকাবেলা করা যায়। সন্ধ্যায় কোঠায় বসে রিফাত অনুভব করল—বিপদের মুহূর্তে সাহসই আত্মাকে শক্ত করে। সে লিখল— বিপদ মানেই ভয় নয় বন্ধুর সমর্থনই বড় শক্তি প্রতিটি প্রহর শিখার সুযোগ আজ রিফাত শুধু প্রতিরোধ শিখেছে না, তিনি শিখেছে সত্যিকারের সাহস মানে ভয়কে স্বীকার করা, কিন্তু সঠিক পথে এগিয়ে যাওয়া। রাতের আলো নিভে যাওয়ার পরও, রিফাত জানালার পাশে বসে তার অভ্যন্তরীণ শক্তি অনুভব করল। তার মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্ম নিল—যে বিপদে সাহস, ধৈর্য ও বুদ্ধি নিয়ে দাঁড়ায়, সে জীবনের যেকোনও বাধা অতিক্রম করতে পারে। অধ্যায় ১৫: আশা ও অন্ধকারের মধ্যকার সংলাপ রিফাতের পঞ্চদশ দিনটি শুরু হলো ভোরের নীরবতায়। কোঠার লোহার দরজা খুলে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হলো—আজ যেন ভেতরের অন্ধকার আরও গভীর। তবে এই অন্ধকারে এক আশার কণিকা ঝলমল করছে। সেলিম এসে বলল, “রিফাত, আমি দেখছি তুমি ভয় পাচ্ছ। কিন্তু মনে রেখো, আশা কখনো হারায় না। আমরা একসাথে থাকলে যেকোনও অন্ধকার অতিক্রম করা সম্ভব।” রিফাত ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করল—ভয় এবং আশা একই সময়ে থাকা যায়, কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় কি শক্তি আশা থেকে পাওয়া যায়। সে নিজেকে বলল, “আমি ভয়কে স্বীকার করি, কিন্তু আমি হাল ছাড়ব না। আশা আমার পথে আলো।” দুপুরের দিকে কোঠার বাইরে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হলো। রিফাত এবং সেলিম ধীরে ধীরে নবাগতদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসে। প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল ভয় ও আশা—একটি পরীক্ষা যেখানে অন্তরের দৃঢ়তা প্রকাশ পায়। সন্ধ্যার আলো নেমে আসলে রিফাত জানালার পাশে বসে ভাবল, “কারাগারের অন্ধকারে, আশা হচ্ছে আমার শক্তি। বিপদের মধ্যে সাহস, ভয়ের মধ্যে ধৈর্য, এই দুই দিয়ে আমি আমার পথ তৈরি করব।” আজ রিফাত বুঝল, আশা ও অন্ধকার একে অপরের পরিপূরক। বিপদ যতই বড় হোক, ভেতরের আলো কখনো নিভে যায় না। অধ্যায় ১৬: বন্ধুত্বের শক্তি রিফাতের ষোড়শ দিনটি শুরু হলো ভোরের আলোয়, কিন্তু কারাগারের পরিবেশে শান্তি কম। কিছু শক্তিশালী বন্দি আবার নতুন সমস্যার সূত্রপাত করছে। তবে আজ রিফাত একা নয়। তার পাশে আছে সেলিম, যার সঙ্গে বন্ধুত্ব দিনে দিনে আরও গভীর হয়েছে। সেলিম বলল, “রিফাত, আমরা একসাথে থাকলে যেকোনও বিপদ মোকাবেলা করতে পারব। বন্ধুত্বই আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি।” রিফাত প্রথমবার অনুভব করল—কারাগারের কঠোর নিয়ম ও অন্ধকারেও বন্ধুত্ব মানসিক শক্তির উৎস হতে পারে। তারা মিলেমিশে— নবাগতদের সাহায্য করল উত্তেজিত বন্দিদের প্রশমিত করল প্রহরীর নজর এড়িয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করল প্রতিটি পদক্ষেপে রিফাতের মনে শক্তি ও আত্মবিশ্বাস বাড়ল। সে বুঝল, যে বিপদের মধ্যে বন্ধু থাকে, সে একা নয়। একতার শক্তি সবচেয়ে বড় অস্ত্র। সন্ধ্যার আলো নেমে আসলে রিফাত জানালার পাশে বসে ভাবল, “আমি শিখেছি—শুধু ধৈর্য, সাহস ও বুদ্ধি নয়, বন্ধুত্বই জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তি। বিপদের সময় বন্ধু পাশে থাকলে আমরা আরও দৃঢ় হতে পারি।” আজ থেকে রিফাতের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে বন্ধুত্বের শক্তি, সাহস ও ধৈর্য একত্রে কাজ করতে শুরু করল। তার ভেতরের অন্ধকার কমে গেল, এবং আশা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। অধ্যায় ১৭: কারাগারের গোপন রণনীতি রিফাতের সপ্তদশ দিনটি শুরু হলো অস্বাভাবিক এক পরিবেশে। সকালের সিটি বাজতেই সবাইকে ডাকা হলো মাঠে, কিন্তু রিফাত লক্ষ্য করল—আজ প্রহরীদের চোখে অদ্ভুত সতর্কতা। সে ধীরে ধীরে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। দেখল— কোন প্রহরী কখন কোন ব্লকে টহল দেয় কোন বন্দি গোপনে অন্যদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে কারাগারের কোথায় নিরাপদ কোণ, আর কোথায় বিপদের সম্ভাবনা বেশি সেলিম বলল, “রিফাত, তুমি কী ভাবছ?” রিফাত হালকা হাসল, “আমি টিকে থাকার রণনীতি খুঁজছি। এখানে শুধু শক্তি নয়, বুদ্ধি এবং পরিকল্পনাই বাঁচার আসল পথ।” তারা তিনজন (রিফাত, সেলিম, আরিফ) মিলে নিজেদের জন্য একটি গোপন পরিকল্পনা করল— ১. প্রতিদিন নতুন বন্দিদের সাহায্য করা, যাতে তারা সমর্থন পায়। ২. সমস্যার সময় প্রহরীদের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে না জড়ানো। ৩. উত্তেজিত বন্দিদের শান্ত করতে কৌশল ব্যবহার করা। ৪. নিজেদের মধ্যে বিশ্বাস অটুট রাখা। দুপুরে এক ছোট সংঘর্ষ হলো। রিফাত তার রণনীতির প্রথম পরীক্ষা দিল। সে আগুনের মতো পরিস্থিতি ধীরে ধীরে শান্ত করে ফেলল। প্রহরী রানা পাশে এসে হেসে বলল, “তুমি ধীরে ধীরে শিখে যাচ্ছ, রিফাত। এখানে শুধু শক্তিশালী নয়, বুদ্ধিমানরাই টিকে থাকে।” সন্ধ্যার আলো নেমে এলে রিফাত জানালার পাশে বসে লিখল— কারাগারের প্রতিটি কোণ একটি পাঠ প্রতিটি বিপদ একটি পরীক্ষা বেঁচে থাকার জন্য শক্তির চেয়ে কৌশল জরুরি আজ রিফাত বুঝল, কারাগারের জীবনকে টিকে থাকার যুদ্ধ বানাতে হলে রণনীতি ছাড়া উপায় নেই। তার মনে দৃঢ়তা জন্ম নিল—যতদিন এখানে থাকবে, ততদিন শিখবে, বুঝবে, আর বাঁচার কৌশল খুঁজে নেবে। অধ্যায় ১৮: অন্তরের ঝড় রাত গভীর। কারাগারের বাতি নিভে গেছে, চারপাশে শুধু প্রহরীদের টহলের শব্দ। রিফাত একা বসে আছে তার ছোট্ট সেলের ভেতর। দিনভর শক্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেও রাত নামলেই তার অন্তরের ঝড় থেমে থাকে না। মনে পড়ে— মায়ের চোখের পানি বাবার নিঃশব্দ অভিমান বোনের কাঁপা কণ্ঠস্বর, “ভাইয়া, কবে ফিরবি?” হঠাৎ বুকটা ভারী হয়ে ওঠে। মনে হয় যেন কারাগারের দেয়াল নয়, নিজের ভেতরের দেয়ালেই সে বন্দি। রিফাত চুপচাপ বিছানার কোণে বসে লিখতে শুরু করল— > “আমি কি সত্যিই অপরাধী? না কি আমি অন্যায়ের শিকার? যদি আমি দোষী না হই, তবে কেন এই শিকল আমার হাতে? যদি আমি দোষী হই, তবে কীভাবে মায়ের চোখের দিকে তাকাব?” প্রতিটি শব্দে তার অন্তরের আগুন জ্বলে ওঠে। সে জানে, বাইরের পৃথিবীতে তার জন্য অপেক্ষা করছে অগণিত প্রশ্ন আর সন্দেহ। আরিফ পাশের সেল থেকে ডাক দিল, “ঘুমাস না, রিফাত?” রিফাত মৃদু স্বরে উত্তর দিল, “ঘুম আসে না, ভেতরে ঝড় উঠেছে।” আরিফ চুপ করে গেল, কারণ সে-ও জানে—এই ঝড়ের মোকাবিলা করতে হয় একাই। রিফাত গভীর শ্বাস নিল। চোখ বন্ধ করে প্রতিজ্ঞা করল— এই ঝড় তাকে ভাঙবে না অন্ধকারের ভেতর থেকেও সে আলো খুঁজবে দুঃখকে শক্তিতে, ভয়কে সাহসে, ব্যথাকে বিশ্বাসে রূপান্তর করবে কারাগারের দেয়ালের বাইরে তখন মৃদু বাতাস বয়ে যাচ্ছিল। মনে হলো—প্রকৃতি যেন ফিসফিস করে বলছে, “ঝড় যতই তীব্র হোক, সকাল একদিন আসবেই।” অধ্যায় ১৯: বন্দিদের গোপন জোট কারাগারের ভেতরটা বাইরে থেকে যেমন নির্জন মনে হয়, ভেতরে তেমন নয়। এখানে প্রতিদিন ঘটে নানা গোপন খেলা। দিনে সবাই শান্ত, নিয়ম মানা বন্দি, কিন্তু রাতে—দেয়ালের আড়ালে জন্ম নেয় এক অদৃশ্য জোট। রিফাত প্রথমদিকে এসব কিছু জানত না। সে ভেবেছিল, কারাগারে শুধু শাস্তি আর দুঃখই আছে। কিন্তু আস্তে আস্তে বুঝল, এখানেও আছে রাজনীতি, ক্ষমতা, আর গোপন সংগঠন। বন্দিদের গোপন বৈঠক এক রাতে, খাবার শেষে সেলের সামনে হঠাৎ করে সোহাগ নামের এক বন্দি এগিয়ে এলো। সে ফিসফিস করে বলল— “ভাই, তোমার মধ্যে সাহস দেখি। শুধু চুপচাপ থাকলে হবে না। আমাদের একটা দল আছে, যারা প্রহরীদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। তুমি চাইলে আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে পার।” রিফাত থমকে গেল। “কোন দল?” সোহাগ মৃদু হেসে বলল, “এই কারাগারটা শুধু প্রহরীদের নয়, আমাদেরও। অন্যায় মারধর, ঘুষ, অতিরিক্ত কাজ—এসব মেনে নেব কেন? আমরা একসঙ্গে হলে ভয় নেই।” দ্বিধা রিফাত চুপ করে গেল। সে জানে, এখানে প্রতিটি সিদ্ধান্ত বিপদ ডেকে আনতে পারে। সে ভাবল— জোটে গেলে হয়তো প্রহরীদের রোষানলে পড়বে আবার না গেলে, সারাজীবন শুধু অন্যায় সহ্য করে যেতে হবে আরিফ পাশে বসে সব শুনছিল। পরে সে রিফাতকে বলল— “দেখো, একা একা কিছু করা যায় না। এখানে টিকে থাকতে হলে কোনো না কোনো দলে যেতে হবে।” গোপন শপথ সেদিন রাতে, চুপিসারে এক অন্ধকার ঘরে কয়েকজন বন্দি জড়ো হলো। হাতে তাদের একটা পুরনো খাতা—তাতে লেখা, “আমরা একসঙ্গে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে।” প্রত্যেকে হাত রেখে শপথ করল। রিফাতও হাত বাড়িয়ে দিল। তার বুকের ভেতর তখনো কাঁপন—কিন্তু চোখে জ্বলে উঠল নতুন আগুন। সংকেত সোহাগ তাকে একটা ছোট্ট লাল কাপড় দিল। “এটাই আমাদের সংকেত। যদি কখনো বিপদে পড়, শুধু এটা দেখাও। আমরা বুঝে যাব।” রিফাত কাপড়টা বুক পকেটে রেখে দিল। এখন সে জানে—তার একার লড়াই নয়। চারপাশে ছড়িয়ে আছে লুকানো শক্তি। কারাগারের দেয়ালগুলো যেন হঠাৎ করেই অন্যরকম মনে হলো। আগে যেটা ছিল নিছক শিকল, এখন সেটা লড়াইয়ের ময়দান। অধ্যায় ২০: বিদ্রোহের আগুন দিনগুলো যেন ধীরে ধীরে জমাট বাঁধছিল। প্রহরীদের অন্যায়, অকারণে মারধর, খাবারের ঘাটতি—সব মিলিয়ে বন্দিদের বুকের ভেতর জমছিল ক্ষোভের আগুন। অন্যায়ের স্ফুলিঙ্গ এক বিকেলে ঘটল সেই ঘটনা। বৃদ্ধ বন্দি হাশেম আলী, যার শরীরে কাজ করার শক্তি নেই, তবুও তাকে জোর করে টানতে নিয়ে গেল প্রহরীরা। ভাতের লাইনে দেরি হওয়ায় তাকে লাঠিপেটা করা হলো। সবাই চুপচাপ দেখে গেল। কিন্তু রিফাতের চোখে তখন রক্ত চড়ে গেছে। সে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল— “এই মারধর কেন? সে কি মানুষ না?” প্রহরীরা রিফাতকেও ধাক্কা দিল। সেদিন থেকে বন্দিদের বুকের ভেতর দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। গোপন বৈঠক রাতে জোটের লোকেরা জড়ো হলো। সোহাগ বলল, “এবার আর চুপ করে থাকা যাবে না। কাল ভোরেই আমরা কাজ করব।” রিফাতের বুক কাঁপছিল। “কী কাজ?” সোহাগ বলল, “একটা বিদ্রোহ। ছোট, কিন্তু শক্ত বার্তা দেবে।” ভোরের ঝড় সকালে কাজের জন্য বন্দিদের মাঠে নামানো হলো। হঠাৎ করে জোটের লোকেরা কাজ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে গেল। একে একে সবাই থেমে গেল। কারাগারের ভেতর গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল—“আর কাজ করব না!” প্রহরীরা ছুটে এল। চিৎকার শুরু হলো। কিন্তু বন্দিরা একসঙ্গে গর্জে উঠল— “আমরা মানুষ! আমাদের অধিকার চাই!” সংঘর্ষ লাঠি উঠল। রক্ত ঝরল। চিৎকার ছড়াল বাতাসে। রিফাতকেও মাটিতে ফেলে পেটানো হলো, কিন্তু সে গলা ফাটিয়ে বলে গেল— “এই রক্ত আমাদের দমাতে পারবে না!” ফলাফল অবশেষে বিদ্রোহ দমন হলো। কয়েকজন গুরুতর আহত হলো। প্রহরীরা আরও কড়া নিয়ম চাপিয়ে দিল। তবু বন্দিদের চোখে দেখা দিল এক নতুন আগুন— তারা বুঝল, ভয় দেখিয়েও আর তাদের থামানো যাবে না। রিফাত রাতে চোখ মুছে আকাশের দিকে তাকাল। সে মনে মনে লিখল— “আজ আমরা হেরেছি, কিন্তু এই হারের ভেতরই জয়ের বীজ রোপণ করেছি।” অধ্যায় ২১: রক্তের দাগ কারাগারের আঙিনায় এখনো শুকায়নি বিদ্রোহের রক্ত। দেয়ালের কোণে, মাটির ফাঁকে ফাঁকে লালচে দাগ যেন চিৎকার করে বলে যাচ্ছে— “মানুষ কেবল বন্দি নয়, সে প্রতিবাদীও।” নীরব আতঙ্ক বিদ্রোহ দমনের পর কারাগারে নেমে এলো ভয়ঙ্কর নীরবতা। প্রহরীদের চোখে অদ্ভুত ঝলক—এবার তারা আরও নির্মম হবে। প্রতিদিন বাড়ছে তল্লাশি, খাবারের পরিমাণ অর্ধেক করে দেওয়া হয়েছে, ছোট্ট ভুলেও শাস্তি। কিন্তু তবুও, বন্দিদের চোখে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা। তারা বোঝে, শিকল যতই টেনে ধরা হোক, আগুন একবার জ্বলে উঠলে আর নিভে না। আহতদের আর্তনাদ হাশেম আলী এখনো শয্যাশায়ী। রক্তের দাগ লেগে আছে তার কাপড়ে। আরিফও আহত হয়েছে, মাথায় গভীর কাটা দাগ। রিফাত তার ক্ষত বেঁধে দিচ্ছিল। সে বলল— “ভাই, আমরা হারিনি। আমাদের রক্ত একদিন কথা বলবে।” আরিফের ঠোঁটে কষ্টের মাঝেও একটুখানি হাসি ফুটল। “হ্যাঁ, এই রক্ত একদিন ইতিহাস লিখবে।” প্রহরীদের ভয় বিদ্রোহ দমন হলেও প্রহরীদের ভেতরে ছড়িয়ে পড়েছে ভয়। তারা বুঝেছে—এই বন্দিদের চুপ করানো সহজ নয়। একজন প্রহরী অন্যজনকে ফিসফিস করে বলছিল— “ওদের চোখে যে আগুন, সেটা যদি বাইরে ছড়িয়ে যায়?” রিফাতের স্বপ্ন রাত গভীরে, যখন চারদিক নিস্তব্ধ, রিফাত সেলের ভেতরে বসে ভাবছিল— “আজ আমরা রক্ত দিলাম, কাল হয়তো এর বিনিময়ে আসবে আলো। মা যদি জানত, আমি শুধু নিজের জন্য নয়, সবার জন্য লড়ছি, তবে হয়তো গর্বিত হতো।” চোখের সামনে ভেসে উঠল মায়ের মুখ, বোনের কণ্ঠস্বর, মুক্ত আকাশ। সে বিড়বিড় করে বলল— “এই রক্তের দাগ মুছবে না, একদিন এই দাগই হবে আমাদের মুক্তির পতাকা।” অধ্যায় ২২: মুক্তির স্বপ্ন কারাগারের আকাশটা সেদিন অদ্ভুত সুন্দর ছিল। ম্লান দেয়ালের ওপরে সোনালি রোদ পড়েছিল, যেন আকাশই বন্দিদের কানে ফিসফিস করে বলছে— “বন্দি হও, তবুও স্বপ্ন দেখো।” বন্দিদের আড্ডা রাতে খাওয়া শেষে কয়েকজন বন্দি এক কোণে বসেছিল। হাশেম আলী, দুর্বল শরীর নিয়ে, মৃদু কণ্ঠে বলল— “আমি হয়তো বাঁচব না। কিন্তু তোমরা বাঁচবে। তোমাদের মুক্তি শুধু নিজের জন্য নয়, দেশের জন্যও হতে হবে।” রিফাত স্তব্ধ হয়ে শুনছিল। সে জানত, এই বৃদ্ধের কথা মাটিতে পড়ে না। সোহাগ বলল— “আমরা এখানে শুধু বন্দি না, আমরা স্বপ্নবাহক। বাইরে লাখো মানুষ অন্যায়ে কাঁদছে। যদি কোনোদিন মুক্তি পাই, তবে সেই কান্না মুছাতে হবে।” রিফাতের কল্পনা সেদিন রাতে ঘুমাতে গিয়ে রিফাত চোখ বন্ধ করল। তার চোখে ভেসে উঠল— মুক্ত বাতাসে দাঁড়িয়ে থাকা নিজেকে মায়ের মুখে শান্তির হাসি গ্রামে ফিরে গিয়ে বোনের হাত ধরে হাঁটা আর মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে বলা, “অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে, তবেই সত্যিকারের স্বাধীনতা আসবে।” চোখের জল গড়িয়ে পড়ল, কিন্তু মনে হলো এ জল দুঃখের নয়—এটা আশার জল। মুক্তির গোপন বার্তা পরদিন সকালের ব্যায়ামের সময় হঠাৎ এক বন্দি রিফাতের হাতে ছোট্ট কাগজ গুঁজে দিল। তাতে লেখা— “বাইরে আন্দোলন হচ্ছে। তোমাদের মুক্তির দাবি উঠেছে।” রিফাত কাগজটা বুকের কাছে চেপে ধরল। তার বুকের ভেতর যেন বজ্রপাত হলো। সে বুঝল—দেয়ালের বাইরের দুনিয়ায়ও তারা একা নয়। নতুন আলো সেদিন রাতে বন্দিদের চোখে ঘুম এলো না। তারা একে অপরকে বলল— “আমরা মুক্ত হব।” “আমাদের স্বপ্ন ভাঙবে না।” রিফাত চুপ করে আকাশের দিকে তাকাল। কারাগারের জানালার সরু ফাঁক দিয়ে তারার আলো ঢুকছিল। সে মনে মনে বলল— “একদিন আমরা এই দেয়াল ভেদ করে দাঁড়াব মুক্ত আকাশের নিচে। সেদিন এই স্বপ্ন আর শুধু স্বপ্ন থাকবে না।” অধ্যায় ২৩: শেষ লড়াই কারাগারের ভেতরে দিনগুলো যেন অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল। প্রহরীরা আগের চেয়ে দ্বিগুণ কড়া, কিন্তু বন্দিদের চোখে এখন ভয় নেই। তাদের বুকের ভেতর গর্জন করছে একটাই কথা— “এবার অথবা কখনোই নয়।” বাইরের ঝড় বাইরের দুনিয়ায় শুরু হয়েছে আন্দোলন। রাস্তায় মানুষ নেমে এসেছে, ব্যানারে লেখা— “বন্দিদের মুক্তি চাই” “অন্যায় বিচার মানি না” এই খবর লুকিয়েও কারাগারের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। একজন প্রহরী ফিসফিস করে বলছিল— “বাইরে আগুন লেগেছে। যদি ভেতরেও জ্বলে ওঠে?” বন্দিদের গোপন পরিকল্পনা সোহাগ, রিফাত, আর কয়েকজন মিলে গোপনে ঠিক করল— “আগামীকাল ভোরে আমরা একযোগে দাঁড়াব। কাজে নামব না, লাইনে দাঁড়াব না, খাবার নেব না। শুধু একসঙ্গে গর্জে উঠব।” রিফাতের চোখে তখন দৃঢ়তা। সে জানত, এটা তাদের শেষ লড়াই হতে পারে। জিতলে মুক্তি, হারলে মৃত্যু। ভোরের গর্জন ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে বন্দিরা একত্র হলো। প্রহরীরা হুইসেল বাজিয়ে ডাকল— “লাইন ধরো! কাজে যাও!” কিন্তু কেউ নড়ল না। রিফাত সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল— “আমরা মানুষ! আমাদের মুক্তি চাই!” মুহূর্তেই শত শত গলা একসঙ্গে গর্জে উঠল। কারাগারের দেয়াল কেঁপে উঠল সেই গর্জনে। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ প্রহরীরা ছুটে এলো, লাঠি উঠল, গুলি ছোড়া হলো। বন্দিদের বুক থেকে রক্ত ঝরতে লাগল। তবুও তারা দমল না। রিফাত লাল কাপড় হাতে উঁচিয়ে বলল— “আজকের রক্ত আগামী দিনের স্বাধীনতার দাম!” শেষ মুহূর্ত রিফাতের শরীরেও গুলি লাগল। সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, কিন্তু ঠোঁটে মৃদু হাসি। চোখ মুছে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল— “মা, আমি আসছি… কিন্তু আমি হেরে যাচ্ছি না।” তার কণ্ঠ মিলিয়ে গেল বন্দিদের গর্জনে। কারাগারের দেয়াল যেন প্রথমবারের মতো কেঁপে উঠল মুক্তির সুরে। অধ্যায় ২৪: মুক্তির আলো কারাগারের ভেতরে রক্তের গন্ধ এখনো ভেসে বেড়াচ্ছে। ভাঙা দেয়াল, ছড়ানো লাঠি, আহত বন্দিদের আর্তনাদ—সব মিলিয়ে ভয়াবহ দৃশ্য। কিন্তু এই অন্ধকারের ভেতরেই যেন জন্ম নিল এক নতুন সূর্য। ভোরের সংবাদ প্রহরীরা চেষ্টা করেও আর বন্দিদের স্তব্ধ করতে পারল না। বিদ্রোহের খবর পৌঁছে গেল দেয়ালের বাইরে। মানুষের ঢল নেমে এলো কারাগারের সামনে— ব্যানারে লেখা: “অন্যায়ের শৃঙ্খল ভাঙো!” “বন্দিদের মুক্তি চাই!” পুলিশ আর প্রশাসন বাধা দিল, কিন্তু মানুষের স্রোত থামল না। কারাগারের ভেতর বন্দিরা গর্জে উঠল, আর বাইরে হাজারো কণ্ঠ প্রতিধ্বনি তুলল। রিফাতের শেষ যাত্রা রিফাত তখন রক্তাক্ত শরীরে মাটিতে শুয়ে। তার নিঃশ্বাস ক্ষীণ, কিন্তু চোখে অদ্ভুত দীপ্তি। সে আরিফের কানে ফিসফিস করে বলল— “আমরা জিতেছি… আমার মা-কে বলবি, তার ছেলে পরাজিত হয়নি।” মুহূর্তেই তার নিঃশ্বাস থেমে গেল। কিন্তু ঠোঁটে রয়ে গেল সেই মৃদু হাসি। দেয়াল ভাঙার মুহূর্ত কিছুক্ষণের মধ্যেই বাইরে থেকে মানুষের চাপে প্রশাসন ঘোষণা দিল— “অন্যায়ভাবে আটক বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হবে।” কারাগারের লোহার দরজা খুলে গেল। শিকল পড়ে গেল মাটিতে। যেন পৃথিবী নতুন করে শ্বাস নিল। মুক্তির আলো বন্দিরা বেরিয়ে এলো রক্তমাখা পোশাকে। তাদের চোখে জল, কিন্তু সেই জল দুঃখের নয়—এটা বিজয়ের। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ তাদের বুকে জড়িয়ে নিল। আকাশ তখন সোনালি আলোয় ভেসে যাচ্ছে। মনে হলো, প্রকৃতিও বলছে— “শৃঙ্খল ভাঙা যায়, রক্ত বৃথা যায় না।” সমাপ্তি রিফাত বেঁচে রইল না, কিন্তু তার স্বপ্ন বেঁচে রইল। তার রক্তের দাগ হয়ে উঠল মুক্তির প্রতীক। বন্দিরা আর মানুষরা একসঙ্গে প্রতিজ্ঞা করল— “অন্যায়ের কারাগার একদিন পুরো ভেঙে ফেলব।” আকাশের দিকে তাকিয়ে কেউ কেউ বলল— “রিফাত মরে যায়নি, সে বেঁচে আছে আমাদের চোখে, আমাদের স্বপ্নে।” সেদিন কারাগারের দেয়াল ভেদ করে সূর্যের আলো যেন নতুন করে জন্ম দিল এক জাতিকে। ✨ শেষ ✨
0 Comments