সুমনের জীবন নদীর তীরে শুরু, যেখানে বাবার সঙ্গে মাছ ধরে জীবন কাটে। ধৈর্য, সাহস, বন্ধুত্ব ও পরিবারের সমর্থনে সে শিখে ঝড়, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বিপদের মোকাবিলা। লীনার সঙ্গে বন্ধুত্ব ও স্বপ্ন তাকে আরও দৃঢ় করে। নদীর প্রতিটি ঢেউ তাকে শেখায় কৌশল, সতর্কতা ও সাহস। প্রথম বিজয়, সাহসিক অভিযান ও ঝড়ের পরীক্ষা—সব মিলিয়ে সুমনের জীবন হয়ে ওঠে জলরাশি; স্বপ্ন, শিক্ষা, সম্পর্ক ও সাহসের সমন্বয়।
📖 উপন্যাস: জলরাশি
জলরাশি অধ্যায় ১: শৈশবের সকাল সুমনের জন্ম নদীর ধারের ছোট্ট গ্রামে। নদীর জল যেমন শীতল, তেমনি তার শৈশবও শান্ত, কিন্তু জীবনের শিক্ষায় পূর্ণ। ভোরে যখন সূর্য কুয়াশার আড়ালে উঠে, সুমন ঘুম ভেঙেই ছুটে যেত নদীর ধারে। তার ছোট পা মাটি ছুঁয়ে হালকা আর্দ্রতা অনুভব করত। নদীর বুকে ভেসে আসা নৌকা, মাছ ধরা জেলের গান, জল ছোঁয়া নরম বাতাস—সবকিছুই যেন তার খেলার মঞ্চ। কখনো বড় জেলের সাথে মাছ ধরার কৌশল শিখত, কখনো নিজের বানানো ছোট নৌকায় খেলাধুলা করত। বাবা বলতেন, “সুমন, নদী আমাদের জীবন। সে যেমন শান্ত, তেমনি ঝড়ও আনে। শিখবে তার সঙ্গে বাঁচতে।” সুমনের মা ঘরে বসে মাছ ছেঁড়ে ভাতের সঙ্গে রান্না করতেন। ছোট ছোট কাজগুলো—মাছ বাছাই, মাটির ঘরের দ্যুতিময় সকাল, পুকুরের ধারে হাঁটা—সবকিছুই তাকে শেখাত ধৈর্য ও যত্ন। সুমন কখনো নদীর জলের সঙ্গে খেলাধুলা করতে করতে চিন্তায় ডুবে যেত। সে ভাবত, “আমি বড় হয়ে এই নদীকে বুঝব, মাছ ধরা শিখব, এবং একদিন বড় জেলের মতো সফল হব।” তার শৈশব কেবল আনন্দ নয়; সঙ্গে ছিল নদীর কঠিন বাস্তবতা। কখনো হঠাৎ ঝড় এসে নৌকা উল্টে দিত, কখনো মাছের অভাব, কখনো বাজারে কম দামের ব্যথা। কিন্তু সব কিছুর মধ্যে সুমন শিখত—পরিশ্রম এবং ধৈর্যই জীবনের মূল। শৈশবের এই সকালে, নদীর বুকে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সুমনের জীবনের প্রথম পাঠ শুরু হলো। নদীর গান তাকে বলল, “ধৈর্য ধরো, সময় আসবে। তোমার জীবন নদীর মতো। কখনো শান্ত, কখনো বেদনাদায়ক, কিন্তু চিরন্তন।” অধ্যায় ২: পরিবার ও গ্রামের জীবন সুমনের জীবন কেবল নদী নয়; তার জীবনের দ্বিতীয় গুরুতর অধ্যায় শুরু হয়েছিল পরিবারের ছোট্ট ঘর থেকে। বাবা রঞ্জিত একজন অভিজ্ঞ জেলে। সকাল হতেই নৌকায় চড়ে নদীতে মাছ ধরার জন্য বের হতেন। মা রেণু দিনের শুরুতে ছেঁড়া মাছ বাছাই, রান্না, ঘর পরিচ্ছন্নতা—সব কিছু সামলাতেন। গ্রামটি নদীর তীরে বিস্তৃত, ছোট ঘর, কাঁচা পথ আর নদী থেকে উঠে আসা তাজা মাছ দিয়ে পরিচিত। গ্রামের মানুষদের জীবনও নদীর মতো—শান্ত, সময়ে সময়ে ঝড়, কখনো বিপদ। তারা একে অপরকে সমর্থন করত। সুমন প্রতিদিন সকালে বাবা ও বড় জেলের সঙ্গে নদীর ধারে যেত। নৌকায় বসে জাল ছুঁড়ে মাছ ধরা, নৌকা চালানো—সবকিছু শিখত। কখনো সে ভুল করত, নৌকা উল্টে যেত, কখনো মাছের জাল ভেঙে যেত। তবে বাবা সবসময় বলতেন, “ভুলে ভয় পাওনা, সুমন। নদী শেখায় ধৈর্য ধরতে, ভুল থেকে শিখতে।” মায়ের সতর্ক দৃষ্টি ও বাবার কঠোর শিক্ষা—দুইয়ের মধ্যে সুমনের মন বড় হতে লাগল। সে বুঝতে পারল, পরিবার ও নদী একে অপরের সঙ্গে কতটা সম্পর্কযুক্ত। নদী যেমন জীবন দেয়, তেমনি পরিবার নিরাপত্তা এবং সাহস। গ্রামের সকালের বাজার, পুকুরের ধারে অন্যান্য জেলেদের কাহিনী—সবকিছুই সুমনের শেখার জায়গা। একদিন বৃদ্ধ জেলেদের সাথে বসে সে শুনল, “নদী যেমন পরিবর্তন হয়, তেমনি আমাদের জীবনও। আজ ভালো, কাল ঝড়। যে ধৈর্য ধরে, সে নদীর মতো স্থির থাকে।” অধ্যায় ৩: প্রথম নৌকা ও মাছ ধরা সুমনের জন্য জীবনের প্রথম বড় রোমাঞ্চ শুরু হলো যখন বাবা তাকে নিজের ছোট নৌকায় নিলেন। ভোরের হাওয়া ঠান্ডা, নদীর জল ঝলমল করছে সূর্যের আলোয়। সুমনের মন কাঁপছিল—উৎসাহ আর ভয়ের মিশ্রণে। “সুমন, আজ তুমি শিখবে নৌকা চালানো আর জাল ছোঁড়া,” বাবা বললেন। “ভয় পেলে চলবে না, নদী কেবল সাহসীকে শেখায়।” নৌকায় বসে সুমনের ছোট হাত জাল ধরে দুলছে। প্রথমবারে জাল ঠিক মতো পড়ল না। মাছ ধরা ব্যর্থ হলো। কিন্তু বাবা ধৈর্য ধরে বুঝালেন—কীভাবে জাল ফেলে, কোথায় মাছ থাকে, কখন ছেড়ে দিতে হয়। সুমন বুঝল, নদী ধীরে ধীরে তাকে পরীক্ষা করছে। ঝড় নয়, বরং ধৈর্য এবং মনোযোগ হলো আসল চাবিকাঠি। প্রথম মাছটি ধরার মুহূর্তে সে যেন উড়ে গেল। ছোট্ট মাছটি নৌকায় উঠতে মাত্র কিছু সেকেন্ড লাগল, কিন্তু তার জন্য সে আনন্দে মুখে হাসি আনল, চোখে জল। নৌকায় বসে নদীর বুক ছুঁইয়ে সুমন অনুভব করল—এই জীবন সহজ নয়, কিন্তু পুরস্কারও বড়। প্রতিটি মাছ, প্রতিটি জালের ছোঁয়া তাকে শেখাচ্ছিল—পরিশ্রমের মূল্য, সতর্কতার শক্তি, এবং নিজের উপর বিশ্বাস। সুমনের বাবা দেখলেন ছেলে কি আনন্দে জ্বলছে। তিনি বললেন, “সুমন, মনে রাখো, নদী কখনো শিথিল হয় না। যারা তার সঙ্গে মিলেমিশে চলে, তারা সফল হয়।” প্রথম নৌকায় প্রথম মাছ ধরা—এই অভিজ্ঞতা সুমনের মনে জীবনের প্রথম বড় শিক্ষা হিসেবে লেগে গেল। নদী, জাল, নৌকা—সব মিলিয়ে তার জলরাশি আরও সমৃদ্ধ হলো। অধ্যায় ৪: বন্ধু ও গ্রামের জীবন সুমনের জীবনে নদীর পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল বন্ধুদের সঙ্গ। গ্রামের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা প্রতিদিন নদীর ধারে মিলিত হতো। কেউ নৌকা চালাতো, কেউ জাল ছোঁড়ার কৌশল শিখত, কেউবা মাছের বাজারে সাহায্য করত। সুমনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল রবিউল। ছোটবেলায় তারা একসঙ্গে নৌকা বানাতো, মাছ ধরার অনুশীলন করত। রবিউল বলত, “সুমন, আজ আমরা বড় জেলের মতো হয়ে যাব। নদী আমাদের বন্ধু, তাকে যদি বোঝতে পারি, সব সম্ভব।” গ্রামের মানুষদের জীবনও নদীর মতো পরিবর্তনশীল। কেউ ধনবান নৌকা চালায়, কেউ ছোট নৌকায় মাছ ধরে সংসার চালায়। বাজারে মাছের দাম ওঠা-নামা, নদীর হঠাৎ ঝড়—সবকিছুই গ্রামের জীবনকে নির্ধারণ করে। সুমন শিখল, শুধুমাত্র নিজের চেষ্টাই যথেষ্ট নয়। বন্ধু ও গ্রামের মানুষের সঙ্গে সহযোগিতা করেও জীবন চালাতে হয়। কেউ বিপদে সাহায্য করবে, কেউ আনন্দে ভাগাভাগি করবে। গ্রামের বুড়ো জেলেরা বলত, “একলা নৌকা চলতে পারে, কিন্তু বড় নদী পার হতে হলে একে অপরের সাহায্য নিতে হবে।” সুমনের বন্ধুত্ব শুধুই খেলা নয়; তা তাকে শিখিয়েছে দায়িত্ব, সহযোগিতা এবং বিশ্বাসের মূল্য। নদীর জল যেমন কখনো শান্ত, কখনো উত্তাল, তেমনি গ্রামের জীবনও—চাহিদা, সমস্যা, সুখ সব মিলেমিশে তৈরি। নদী, পরিবার ও বন্ধু—এই তিনটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়েই সুমনের জলরাশি ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে। নদী যেমন তাকে শেখাচ্ছে ধৈর্য, তেমনি বন্ধুরা শিখাচ্ছে মানবিকতা। অধ্যায় ৫: নদীর পাঠ নদী সুমনের জন্য কেবল জল নয়; এটি ছিল শিক্ষক, বন্ধু ও প্রতিফলন। প্রতিদিন সকালে নৌকায় বসে নদীর পানি ছুঁয়ে সে শিখত জীবনের নানা পাঠ। বাবা বলতেন, “সুমন, নদী আমাদের জীবন। কখনো শান্ত, কখনো উত্তাল। যিনি তার গতির সঙ্গে মিলেমিশে চলেন, তিনি সফল হন।” সুমন প্রথমে ঠিক বুঝতে পারত না। ঝড় এলে সে ভয় পেত। কিন্তু ছোট ছোট অভিজ্ঞতা তাকে শেখাল—নদী কখনো চুপচাপ থাকে না, তার আন্দোলন জীবনের মতোই পরিবর্তনশীল। মাছের আনা-না আনা, নৌকায় উল্টে যাওয়া, জাল ভেঙে যাওয়া—সবই শেখায় ধৈর্য এবং কৌশল। একদিন বড় জেলের সঙ্গে নদীর মাঝখানে বসে সুমন জিজ্ঞেস করল, “আমরা কি সবসময় মাছ পাবো?” বড় জেল উত্তর দিলেন, “না, সুমন। নদী যেমন সময়ে সময়ে বাধা দেয়, তেমনি কখনো অপ্রত্যাশিত আনন্দও দেয়। শিক্ষা হলো—ভয় না পেয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাও।” সুমন বুঝল, নদীর সঙ্গে যুদ্ধে জেতার মানে শুধু মাছ ধরা নয়। সাহস, ধৈর্য, পর্যবেক্ষণ—এগুলোই মূল জয়। নদী তাকে শিখিয়েছে, জীবনেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সুমন লক্ষ্য করল, নদীর প্রতিটি ঢেউ, প্রতিটি স্রোত, প্রতিটি মাছের কাঁপন—সবই তার অভিজ্ঞতা বাড়াচ্ছে। সে অনুভব করল, নদী কেবল শারীরিক শক্তি নয়, মানসিক ও মননের শক্তিও দেয়। নদীর পাঠ সুমনের জন্য এক নতুন দিগন্ত খুলে দিল। ধীরে ধীরে সে শিখল—জীবনের সব ঝড়, সব বাধা, সব কষ্টই শুধুমাত্র নদীর মতো শেখার মাধ্যম। অধ্যায় ৬: ছোট ধান্দা সুমনের জীবন কেবল নদী আর নৌকা নয়; পরিবারকে সাহায্য করা এবং জীবনের ছোট ছোট দায়িত্বও ছিল তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পাঠ। ছোটবেলা থেকেই সে শিখেছিল, বড় হওয়া মানে শুধু নিজের জন্য নয়, পরিবার ও গ্রামকে সাহায্য করা। প্রতি বিকেল সুমন বাজারে যেত। বাবার সঙ্গে মাছ বিক্রি করত, মায়ের সঙ্গে রান্না ও ঘর পরিচ্ছন্নতা সামলাত। গ্রামের মানুষদের সাথে মিশে সে শিখল—আন্তরিকতা, সততা এবং কঠোর পরিশ্রম। একদিন সুমন দেখতে পেল, গ্রামের এক বৃদ্ধ জেলে নৌকা মেরামত করতে পারেনি। সে সাহায্য করতে এগিয়ে গেল। বৃদ্ধ হাসলেন, “সুমন, ছোট ছোট সাহায্যই বড় পার্থক্য গড়ে তোলে। জীবন নদীর মতো—যে যত সহযোগিতা জানে, সে তত সফল হয়।” ছোট ধান্দার মধ্য দিয়ে সুমন শিখল জীবনের ন্যায্যতা ও দায়িত্ববোধ। মাছের বাজারে কখনো দাম কমে, কখনো জালের কিছু অংশ নষ্ট হয়, তবে সব কিছুর মধ্যে সে দেখল—পরিশ্রম এবং সততা সবসময় ফল দেয়, যদি ধৈর্য থাকে। সুমনের এই ছোট ধান্দা শুধু অর্থ উপার্জনের মাধ্যম নয়; এটি তাকে জেলের জীবন, পরিবারের বন্ধন এবং গ্রামের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক বোঝায়। প্রতিটি ছোট কাজ, প্রতিটি সাহায্য—সবই নদীর মতো তাকে শক্তি দিচ্ছিল। অধ্যায় ৭: প্রথম ঝড় সুমনের জীবনের জন্য আসল পরীক্ষা শুরু হলো প্রথম বড় ঝড়ের সময়। ভোরবেলা নৌকায় বসে বাবা মাছ ধরতে গিয়েছিলেন, হঠাৎ আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেল। বাতাস উষ্ণ থেকে তীব্র হল, নদী উত্তাল হয়ে উঠল। সুমনের মন কাঁপছিল। সে বলল, “বাবা, কি হবে? আমরা কি নিরাপদে ফিরতে পারব?” বাবা ধীরে বললেন, “সুমন, জীবন নদীর মতোই। কখনো শান্ত, কখনো ঝড়। সাহসী হলে ঝড়কে মোকাবিলা করা যায়।” নৌকা হালকা দুলতে লাগল। বড় ঢেউ তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। সুমন দেখল, জালের কিছু অংশ ভেঙে গেছে। সে ভয়ে দিশেহারা। কিন্তু বাবার দৃঢ়তা তাকে শান্ত করল। বাবা শেখাল—ঝড়ে ভয় পাওয়া নয়, নৌকা ঠিকভাবে ধরে রাখা, নৌকা চালানো এবং একে অপরের সাহায্য করা হলো মূল শিক্ষণীয়। একে অপরের হাত ধরে, ধৈর্য ধরে, তারা নদীর উত্তাল জলে নিজেকে স্থির রাখল। কয়েক ঘন্টার কঠোর পরিশ্রমের পরে ঝড় থামল। নদী আবার শান্ত হল। সুমন বুঝল—জীবনের ঝড় যেমন অপ্রত্যাশিত আসে, তেমনি মোকাবিলাও সম্ভব। সাহস, ধৈর্য এবং বিশ্বাসই বিপদে জীবনের হাত ধরে রাখে। অধ্যায় ৮: পরীক্ষা ও ধৈর্য ঝড়ের পরে নদী শান্ত হলেও, সুমনের জীবন আর আগের মতো সহজ ছিল না। সে বুঝল, জেলের জীবন শুধু মাছ ধরা নয়, বরং অবিরাম পরীক্ষা, ধৈর্য এবং সাহসের লড়াই। নদীর প্রতিটি ঢেউ, প্রতিটি স্রোত তাকে আবার পরীক্ষা করত। ছোট নৌকা চালানো, জাল ঠিকভাবে ছোঁড়া, মাছ ধরার জন্য সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া—সবই একটি ধরনের পরীক্ষা। একদিন সুমন নদীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে ভাবল, “আমি কি যথেষ্ট ধৈর্য ধরতে পারব? কি আমি বড় জেলের মতো হতে পারব?” বাবা পাশে এসে বললেন, “সুমন, পরীক্ষা সবসময় আসে। যিনি ধৈর্য ধরে, যিনি নদীর সঙ্গে মিলেমিশে চলেন, তিনি শেষ পর্যন্ত সফল হন। ভয় পেলে কখনো সফল হওয়া যায় না।” সুমন ধীরে ধীরে শিখল—বিপদ, সমস্যা এবং প্রতিকূলতা জীবনের অংশ। ধৈর্য ধরে এগোলে, সকল বাধা অতিক্রম করা সম্ভব। ঝড়ের অভিজ্ঞতা, নৌকা, জাল, নদী—সব মিলিয়ে তাকে আত্মবিশ্বাসী ও দৃঢ় করে তুলেছে। নদীর ঢেউ যেমন সময়ে সময়ে পরিবর্তিত হয়, তেমনি সুমনের জীবনও শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে পরিবর্তিত হলো। প্রতিটি পরীক্ষা তাকে আরও শক্তিশালী, আরও সচেতন এবং আরও সাহসী করে তুলল। অধ্যায় ৯: স্বপ্নের আলো ঝড়, পরীক্ষা ও ধৈর্য—সবকিছুর মাঝেই সুমনের মনে জাগল একটি স্বপ্নের আলো। সে ভাবত, নদীকে ভালোভাবে বুঝে, বড় জেলের মতো দক্ষ হয়ে, তার পরিবারকে নিরাপদ ও সুখী জীবন দিতে হবে। প্রতিদিন সকালে নৌকায় বসে নদীর জল ছুঁয়ে, সে কল্পনা করত—কত বড় নদীতে মাছ ধরা, শহরের বাজারে নিজের নাম করা, এবং পরিবারের স্বপ্ন পূরণ করা। বাবা বলতেন, “সুমন, স্বপ্ন দেখো, তবে নদীর মতো ধৈর্য ধরো। স্বপ্ন পূরণের পথে কঠোর পরিশ্রম অপরিহার্য।” সুমনের চোখে নতুন উদ্যম জ্বলে উঠল। ছোট ছোট ব্যর্থতা, ঝড়ের অভিজ্ঞতা—সবই তাকে শেখালো শক্তি, ধৈর্য এবং আশাবাদী মনোভাব ধরে রাখা। বন্ধুরা যখন খেলাধুলায় ব্যস্ত, সুমন কখনো নদীর স্রোত বিশ্লেষণ করত, কখনো জালের ধরন পরীক্ষা করত। সে জানত, শুধু স্বপ্ন দেখা নয়—স্বপ্ন পূরণের জন্য কাজ করা প্রয়োজন। গ্রামের বুড়ো জেলেরা বলতেন, “স্বপ্নই নদীর মতো। যদি বোঝো, বুঝে চেষ্টা করো, সে তোমাকে দূরে পৌঁছে দেবে।” সুমনের জীবনের জলরাশি এখন শুধু নদী, পরিবার বা বন্ধু নয়; এটি তার স্বপ্ন ও আশা দিয়ে আরও সমৃদ্ধ। নদী যেমন শান্ত ও উত্তাল হয়, তেমনি স্বপ্নও কখনো স্পষ্ট, কখনো অস্পষ্ট। তবে ধৈর্য এবং পরিশ্রম থাকলে প্রতিটি স্বপ্ন সম্ভব। এভাবেই, সুমনের জীবনে জন্ম নিল স্বপ্নের আলো, যা তার পরবর্তী অধ্যায়ের অভিযান এবং সংগ্রামের শক্তি হিসেবে কাজ করবে। অধ্যায় ১০: প্রেমের ছোঁয়া সুমনের জীবন কেবল নদী, নৌকা, মাছ আর স্বপ্ন নয়; এখন তাতে এসেছে প্রেমের হালকা ছোঁয়া। গ্রামের একটি মেয়ে, লীনা, প্রতিদিন নদীর ধারে মাছ শুকোতে আসে। ছোটবেলায় তারা একে অপরকে চেনত না, কিন্তু ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। একদিন সুমন নদীর ধারে মাছের জাল মেরামত করছিল, লীনা তাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি সবসময় নদীর সঙ্গে সময় কাটাও?” সুমন হাসি দিয়ে বলল, “হ্যাঁ, নদী আমার বন্ধু। সে আমাকে শেখায় ধৈর্য, সাহস আর স্বপ্ন দেখতে।” লীনা তাকিয়ে রইল, যেন তার চোখে নদীর শান্তি প্রতিফলিত হচ্ছে। সেখানেই সুমনের মনে হলো—বন্ধুত্বের চেয়ে সুন্দর অনুভূতি আছে, সেটি হলো ভালবাসা। সুমন শিখল, নদীর মতোই সম্পর্কও পরিবর্তনশীল। কখনো হাসি, কখনো দুঃখ—সবই জীবনের অংশ। বন্ধুদের সঙ্গে কাটানো সময়, নদীর ধারে হাঁটা, একসাথে মাছ শুকানো—সবই তাদের বন্ধুত্বকে গভীর করল। বাবা বললেন, “সুমন, নদী যেমন ধৈর্য শেখায়, প্রেমও শেখায় মনকে ভালোভাবে অনুভব করতে। কিন্তু সতর্ক থাকো—প্রেমের মতো সম্পর্কও নদীর মতো যত্ন চাই।” লীনার সঙ্গে সম্পর্ক সুমনের জলরাশি-তে একটি নতুন রঙ যোগ করল। নদীর সঙ্গে তার বন্ধন, পরিবার এবং স্বপ্ন—সব মিলিয়ে এখন প্রেমের আনন্দও তার জীবনের অংশ। অধ্যায় ১১: সপ্তাহের সংগ্রাম সুমনের জীবনে নদী, পরিবার ও প্রেম—সব মিলেই এখন শুরু হলো সাপ্তাহিক সংগ্রামের দিন। প্রতিদিন সকালে নৌকা নিয়ে নদীতে মাছ ধরতে যেতো, বিকেলে মাছ বিক্রি ও বাড়ির কাজ। কখনো বন্ধুদের সঙ্গে নৌকায় ঝড় মোকাবিলা, কখনো বাজারে দাম কমে যাওয়া—সবই তার জীবনের অংশ। একদিন নদীতে মাছ কম পাওয়ায় সুমন ভীষণ হতাশ। সে ভাবল, “কেন আমি এত পরিশ্রম করি, অথচ ফল কম?” বাবা পাশে এসে বললেন, “সুমন, জীবন সবসময় সরল নয়। ধৈর্য ধরো। তুমি যত চেষ্টা করবে, সফলতা ধীরে ধীরে আসবে।” সুমন শিখল—পরিশ্রম ও ধৈর্যই জীবনের মূল চাবিকাঠি। প্রতিদিনের ছোট ছোট সংগ্রাম, ঝড়ের মুখোমুখি হওয়া, জালের ভাঙা—সব মিলিয়ে তাকে শক্তিশালী করে। বন্ধু রবিউল বলল, “সুমন, আমাদের জীবন নদীর মতো। কখনো শান্ত, কখনো উত্তাল। আমরা যদি একে অপরের পাশে থাকি, সব কিছু সহজ হয়।” সপ্তাহের এই সংগ্রাম সুমনের জন্য শুধু দৈনন্দিন জীবনের চ্যালেঞ্জ নয়; এটি ধৈর্য, সাহস এবং আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার পাঠ। নদী যেমন তাকে পরীক্ষা করেছিল, তেমনি এই পরিশ্রম তাকে শিখিয়েছে—পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবনকে সুন্দর করে তোলা যায়। সপ্তাহের শেষে, সুমন নৌকায় বসে নদীর শান্ত জলে তাকাল। সে বুঝল, এই সংগ্রামই তার জীবনের জলরাশি-কে সমৃদ্ধ করছে—নদী, পরিবার, বন্ধু, প্রেম এবং স্বপ্নের সঙ্গে মিলিত এক জীবনের পাঠ। অধ্যায় ১২: বিপদের সকাল সপ্তাহের সংগ্রামের পর সকালটি শান্ত মনে হলেও, নদীর ধারে আসল বিপদ ঘনিয়ে আসে হঠাৎ। এক সকালে সুমন নৌকায় বসে মাছ ধরতে গেল, হঠাৎ দেখল নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে উঁচু হয়ে উঠছে। বাবা দ্রুত বললেন, “সুমন, সতর্ক হও! নদী আজ বিপদের সংকেত দিচ্ছে। আমাদের নৌকা ঠিক রাখতে হবে।” সুমনের মন কাঁপছে। প্রথমে সে ভয় পেল, কিন্তু বাবা বললেন, “ভয়কে বন্ধু বানাও না। সাহস ধরো, ধৈর্য রাখো, এবং একে অপরকে সাহায্য করো।” নদীর ঢেউ উঁচু হচ্ছে, নৌকা দুলছে। সুমন বুঝল, জীবনে সবসময় ঝড় আসবে—প্রকৃতি যেমন অনিশ্চিত, তেমনি মানুষের জীবনও অনিশ্চিত। তাকে শিখতে হবে, ঝড়ের মধ্যেও শান্ত থাকা এবং সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া। বড় ঢেউয়ের মধ্যে সুমন ও বাবা একে অপরের হাত ধরে নৌকা স্থির রাখল। নৌকা উল্টে যাওয়া থেকে রক্ষা পেল। এই বিপদের সকাল শিখিয়েছে—জীবনের ঝড় মোকাবিলায় ধৈর্য, সাহস এবং সতর্কতা অপরিহার্য। এই অভিজ্ঞতা সুমনের জলরাশি-তে একটি নতুন পাঠ যোগ করল। ঝড়ের মুখোমুখি হয়ে সে বুঝল—বিপদ শুধু ভয় নয়, এটি শেখার এবং শক্তিশালী হওয়ার সুযোগও দেয়। নদীর শান্ত জল ফেরার পরে, সুমন বুঝল—প্রকৃতির শক্তি, মানুষের ধৈর্য এবং পারস্পরিক সহযোগিতা মিলেই জীবনকে সুন্দর করে। অধ্যায় ১৩: নদীর গল্প ঝড়ের বিপদের পর, সুমন নদীর ধারে বসে বৃদ্ধ জেলেদের গল্প শোনার সুযোগ পেল। তারা বলল, “নদী শুধু জল নয়, এটি ইতিহাস, জীবন, শিক্ষা। যারা নদী বোঝে, তারা জীবনের সব পাঠও বুঝতে পারে।” সুমন কৌতূহলে ভরে জিজ্ঞেস করল, “দাদা, নদী আমাদের কী শেখায়?” একজন বুড়ো জেল হাসলেন, “নদী শেখায়—ধৈর্য, সাহস, সততা এবং একে অপরের সাহায্য করা। অনেক বছর ধরে আমরা নদীর সঙ্গে লড়াই করেছি। আমাদের জীবনও নদীর মতো—শান্ত কখনো, উত্তাল কখনো। নদীকে যদি বোঝো, সে তোমাকে বিপদ থেকে রক্ষা করবে, এবং আনন্দ দেবে।” সুমন শোনল নদীর প্রাচীন গল্প—কিভাবে নদী মানুষের জীবন পরিবর্তন করেছে, কোন সময় বড় জেলের মাছ ধরা সম্ভব হয়েছে, কখন ঝড় এসেছে, আর কখন শান্তি ছিল। এই গল্পগুলো শুধু ইতিহাস নয়; এগুলো জেলের জীবনের পাঠ। নদী যেমন জীবনের চক্রে শান্তি ও ঝড় আনে, তেমনি মানুষও শিখে—পরিশ্রম, সততা এবং সহযোগিতায় সফলতা আসে। সুমনের মনে হলো, নদীর প্রতিটি ঢেউ, প্রতিটি স্রোত, প্রতিটি মাছের ছোঁয়া—সবই জীবনের গল্প এবং শিক্ষা। নদী শুধু জীবন দেয় না, জীবন শেখায়। অধ্যায় ১৪: সাহসিক অভিযান সুমনের জীবনে এসেছে নতুন চ্যালেঞ্জ—সাহসিক অভিযান। একদিন গ্রামের বড় জেলেরা নদীর আরও দূরের অংশে মাছ ধরার পরিকল্পনা করল। সুমন ও রবিউলকে নিয়ে ছোট নৌকা প্রস্তুত হলো। সুমনের হৃদয় দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছিল—উৎসাহ ও ভয়ের মিশ্রণে। সে ভাবল, “আমি কি পারব? কি আমি ঝড় ও অজানা জলের মুখোমুখি হতে পারব?” বাবা বললেন, “সাহসী হও, সুমন। নদীর সাথে মিলেমিশে চললে সব সম্ভব।” নৌকা নদীর ধীরে-ধীরে গভীর অংশে পৌঁছাল। সুমন লক্ষ্য করল—নদীর ধারা পরিবর্তিত হচ্ছে, ঢেউ বেড়েছে। সে বুঝল, সাহস মানে শুধু ভয়হীন হওয়া নয়, সতর্কতা এবং বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এগোতে পারা। রবিউল পাশে ছিল, হাত ধরে সমর্থন করছিল। একসাথে তারা জাল ছুঁড়ল, নৌকা চালাল, এবং প্রথমবার অনেক দূরের মাছ ধরল। সুমন শিখল—সাহস ও একতা মিলেই বড় সাফল্য আনে। এই সাহসিক অভিযান তার জীবনের জলরাশি-তে নতুন দিক যুক্ত করল। নদী যেমন পরীক্ষা নিয়েছে, তেমনি এই অভিযানও তাকে শিখিয়েছে—নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য বিশ্বাস, ধৈর্য এবং সাহস অপরিহার্য। অধ্যায় ১৫: প্রথম বড় প্রতিদ্বন্দ্বিতা সুমনের জীবনে এসেছে নতুন অধ্যায়—প্রথম বড় প্রতিদ্বন্দ্বিতা। গ্রামের এক বড় মাছ ধরার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সুমন, রবিউল এবং অন্যান্য জেলেরা অংশগ্রহণ করল। প্রতিযোগিতার দিন সকালে নদী শান্ত মনে হলেও, সুমনের মনে উত্তেজনা। সে ভাবল, “আমি কি বিজয়ী হব? কি আমার ধৈর্য, কৌশল এবং সাহস যথেষ্ট?” বাজার থেকে দেখল অনেক বড় জেলেরা বড় নৌকায়, দীর্ঘ অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছে। সুমনের ছোট নৌকা ও সীমিত অভিজ্ঞতা—সব মিলিয়ে চ্যালেঞ্জ বড়। প্রতিযোগিতা শুরু হলো। নৌকা চালানো, জাল ছোঁড়া, মাছ ধরার কৌশল—সব কিছুই পরীক্ষা হলো। সুমন প্রথমে পিছিয়ে গেল, কিন্তু বাবার শেখানো ধৈর্য তাকে ধরে রাখল। সে মনোযোগ দিয়ে জালের ধরন, মাছের অবস্থান, স্রোতের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করল। শেষে, সুমনের ধৈর্য এবং কৌশল তাকে বিজয় এনে দিল না হয়তো শীর্ষে, কিন্তু পরিচিতি, আত্মবিশ্বাস এবং শেখার মূল্য অর্জন করল। বড় জেলেরা তাকে প্রশংসা করল, বলল, “তুমি ছোট, কিন্তু দৃঢ় এবং সাহসী। নদীর মতো পরীক্ষা কাটিয়েছ—সফল হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছ।” প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বিতা সুমনের জলরাশি-কে আরও সমৃদ্ধ করল। নদী, পরিবার, বন্ধু, স্বপ্ন এবং এখন প্রতিদ্বন্দ্বিতা—সব মিলিয়ে তার জীবনে শক্তি, ধৈর্য এবং সাহস নিয়ে এসেছে। অধ্যায় ১৬: ঝড়ের মধ্য দিয়ে শিক্ষা প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বিতার অভিজ্ঞতা সুমনকে সাহস দিয়েছিল, কিন্তু জীবনের আরও বড় পরীক্ষা অপেক্ষা করছিল—নদীর মাঝে হঠাৎ ঝড়। একদিন সকালে সুমন নৌকায় বসে মাছ ধরছিল। হঠাৎ আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেল, বাতাস উত্তাল হয়ে উঠল। নদীর ঢেউ বড় হয়ে নৌকাকে দুলাতে লাগল। সুমনের মনে ভয় এলো। সে বলল, “বাবা, আমরা কি নিরাপদে ফিরতে পারব?” বাবা শান্ত স্বরে বললেন, “সুমন, ভয়কে বন্ধু বানিও না। সাহস ধরো, একে অপরকে সাহায্য করো, এবং মনোযোগ রাখো।” সুমন তখন বুঝল—ঝড় মানে শুধু বিপদ নয়, শিক্ষা। তিনি নৌকা ঠিক রাখল, জাল নিয়ন্ত্রণ করল, এবং নদীর গতিকে বোঝার চেষ্টা করল। রবিউল পাশে থেকে সাহায্য করছিল। একসাথে তারা নৌকা পরিচালনা করল, এবং ঝড়ের মধ্যে নিরাপদে ফিরে এল। বড় ঢেউ, বাতাসের তীব্রতা—সবকিছুই তাকে শেখাল সাহস, ধৈর্য এবং সতর্কতা। ঝড় কেবল বিপদ নয়, এটি জীবনকে শক্তিশালী করার মাধ্যম। নদী শান্ত হয়ে যাওয়ার পর সুমন বুঝল—প্রতিটি বিপদ তাকে নতুন শিক্ষা, নতুন দক্ষতা এবং আত্মবিশ্বাস দিচ্ছে। ঝড়ের মধ্য দিয়ে জীবন শিখায় যে, ধৈর্য ধরে, সাহসী এবং প্রস্তুত থাকলেই প্রতিটি বিপদ মোকাবিলা সম্ভব। অধ্যায় ১৭: নদীর গোপন রত্ন ঝড়ের পর নদী আবার শান্ত। কিন্তু সুমনের কৌতূহল বেড়েছে। নদীর মাঝে লুকানো কিছু গোপন রহস্য ও রত্ন আছে কি না—সে জানতে চায়। একদিন সে বাবার সঙ্গে নৌকায় বের হলো। নদীর ধারে এক ছোট পাথরের নিচে মাছের বড় দল ভেসে উঠেছে। বাবা বললেন, “সুমন, নদী শুধু মাছ দেয় না, অনেক শিক্ষা দেয়। তবে কখনো কখনো তা লুকিয়ে রাখে—যে ধৈর্যধরী, সে তা খুঁজে পায়।” সুমন ধীরে ধীরে জাল ছুঁড়ল, মাছ ধরল, এবং সেই ছোট পাথরের নিচে একটি পুরোনো নৌকার খণ্ড দেখতে পেল। এটি যেন নদীর গোপন রত্ন—অতীতের গল্প, সময়ের সাক্ষী। বৃদ্ধ জেলেরা বলল, “প্রকৃতির মাঝে অনেক গোপন রহস্য থাকে। যারা চোখ রাখে, মন রাখে, তারা সব দেখবে। নদীর জলে শুধু মাছ নয়, জীবন ও ইতিহাসও ভাসে।” সুমন বুঝল, নদী শুধু শারীরিক ও মানসিক শিক্ষা দেয় না; এটি অতীতের গল্প, অভিজ্ঞতা এবং জীবনের রত্নও বহন করে। অধ্যায় ১৮: বন্ধুত্বের শক্তি নদীর শিকড়ে, ঘাটে, নৌকায়—সুমন শিখল যে জীবনের সবকিছু সম্ভব হয় বন্ধুত্বের শক্তি দিয়ে। রবিউল তার পাশে ছিল, ঝড়ে, নৌকা চালাতে, জাল ধরাতে, এবং বিপদে। একদিন নদীর মাঝে জাল ধরা নিয়ে তারা দুই বন্ধু আলোচনায় বসল। রবিউল বলল, “সুমন, যদি একা চেষ্টা করতাম, আজ সম্ভবত আমি মাছ ধরতাম না। বন্ধু থাকলে, কাজ সহজ হয়, সাহস বেড়ে যায়।” সুমন বুঝল—নৌকা যেমন নদীর স্রোতের সঙ্গে মিলেমিশে চলে, তেমনি জীবনও বন্ধুর সঙ্গে সহযোগিতায় সুন্দর হয়। নদীর ঝড়, উত্তাল স্রোত, জালের ভাঙা—সবকিছু মিলিয়ে বন্ধুত্বই শক্তি। বৃদ্ধ জেলেরা বলল, “একলা নৌকা পার হতে পারে, কিন্তু বড় নদী পার হতে হলে বন্ধু বা সহযাত্রী অপরিহার্য।” বন্ধুত্ব শুধু সাহায্য নয়; এটি শেখায় সহনশীলতা, বিশ্বাস এবং একে অপরের পাশে থাকা। নদী যেমন সব পরীক্ষা নিয়ে আসে, তেমনি বন্ধুত্বও জীবনের সব সমস্যার সমাধানে সাহায্য করে। অধ্যায় ১৯: প্রথম বিজয় নদীর সাথে লড়াই, ঝড়, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ধৈর্যের পাঠ—সবকিছু মিলিয়ে সুমনের জীবনে এসেছে প্রথম বড় বিজয়। গ্রামে বড় মাছ ধরার প্রতিযোগিতার ফলাফল ঘোষণা হলো। সুমন ও রবিউল তাদের ছোট নৌকা নিয়ে অংশ নিয়েছিল। ফলাফল ঘোষণা হলো—সুমন ও রবিউলের নাম উঠে এল প্রশংসার সঙ্গে। যদিও তারা প্রথম হয়নি, কিন্তু অভিজ্ঞতা, ধৈর্য এবং কৌশলের জন্য তাদেরকে সম্মান জানানো হলো। বাবা বললেন, “সুমন, মনে রেখো, বড় বিজয় কেবল শীর্ষে ওঠা নয়। প্রক্রিয়া, শিক্ষা, ধৈর্য—এগুলোই আসল বিজয়।” সুমনের মনে হলো—প্রথম বড় বিজয় মানেই নিজের উপর বিশ্বাস, ধৈর্য এবং কৌশল প্রয়োগের স্বীকৃতি। নদী, ঝড়, বন্ধুত্ব, পরিবার, সাহস—সব মিলিয়ে এটি তার জীবনের এক নতুন অধ্যায়। রবিউল বলল, “সুমন, আমরা শিখেছি কিভাবে কঠোর পরিশ্রম, ধৈর্য এবং সহযোগিতা বড় ফল দেয়। এটি আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় পাঠ।” এই প্রথম বিজয় সুমনের জলরাশি-কে আরও সমৃদ্ধ করল। নদী তাকে শিখিয়েছে, জীবন কখনো সহজ নয়, কিন্তু ধৈর্য, সাহস, বন্ধুত্ব এবং পরিবারের সমর্থনে সবকিছু সম্ভব। অধ্যায় ২০: বড় ঝড়ের প্রস্তুতি নদীর শান্তি দীর্ঘ স্থায়ী হয় না। গ্রামের বুড়ো জেলেরা জানিয়েছিল, শীতের আগে একটি বড় ঝড় আসছে। সুমন জানল, এটি তার জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হতে পারে। বাবা বললেন, “সুমন, বড় ঝড় মানে শুধু বিপদ নয়। এটি তোমার ধৈর্য, সাহস এবং প্রস্তুতির পরীক্ষা।” সুমন ও রবিউল নৌকা, জাল এবং সমস্ত সরঞ্জাম পরীক্ষা করল। ঝড় মোকাবিলার জন্য ধৈর্য, কৌশল এবং সতর্কতা জরুরি। নদীর গতিবিধি, স্রোতের পরিবর্তন, আকাশের মেঘ—সবকিছু মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে হলো। সুমন শিখল, ঝড়ের আগে প্রস্তুতি শুধু সরঞ্জাম নয়, মানসিক শক্তিও তৈরি করা। তিনি নদীর আচরণ বোঝার চেষ্টা করল, ঝড়ের সময় কীভাবে স্থিতিশীল থাকা যায়, কিভাবে জালের ব্যবহার করতে হয়—সব পরিকল্পনা করল। বৃদ্ধ জেলেরা বলল, “ঝড় আসার আগে যারা ধৈর্য ধরে প্রস্তুতি নেয়, তারা জীবনে সফল হয়। ধৈর্য এবং প্রস্তুতি মিলেই বিপদকে জয় করা যায়।” অধ্যায় ২১: ঝড়ের মুখোমুখি অপেক্ষার শেষ হলো। সেই বড় ঝড় নদীর ধারে এসে থমকে দাঁড়াল। সুমন ও রবিউল নৌকায় বসে ছিল—প্রস্তুত, সতর্ক, এবং দৃঢ়। বাতাস তীব্র, নদীর ঢেউ বড়। নৌকা দুলছে, জাল ভেঙে যাচ্ছে। সুমনের মন কাঁপছিল, কিন্তু বাবার শিক্ষা মনে পড়ল— “ভয়কে বন্ধু বানিও না। সাহস, ধৈর্য এবং সতর্কতা ধরো। একে অপরকে সাহায্য করো।” নৌকা চালানো, জাল ঠিক রাখা, ঢেউয়ের সঙ্গে মিলেমিশে চলা—সবকিছুই পরীক্ষা। সুমন শিখল, ঝড় মানে শুধু বিপদ নয়, জীবনের বাস্তব শিক্ষা। নদীর শক্তি মোকাবিলায় ধৈর্য ও কৌশল অপরিহার্য। অধ্যায় ২২: স্বপ্নের পূর্ণতা ঝড়ের পরীক্ষার পর, সুমন অনুভব করল—তার স্বপ্ন ধীরে ধীরে পূর্ণ হতে শুরু করেছে। নদীর সঙ্গে তার বন্ধন, জেলের জীবন, ধৈর্য, সাহস, বন্ধুত্ব এবং প্রথম বিজয়—সব মিলিয়ে স্বপ্নের আলো আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। সুমন ভাবল, “আমি কেবল নিজের জন্য নয়, পরিবার ও গ্রামের জন্যও কিছু করতে পারি।” বাজারে মাছ বিক্রি, নদীর ধারে শেখানো নতুন জেলেদের কৌশল, বন্ধুদের সঙ্গে সহযোগিতা—সব মিলিয়ে তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের দিকে এগোচ্ছে। বড় জেলেরা বলল, “সুমন, তুমি শুধু মাছ ধরছো না, জীবন ধরছো। তুমি শিখছো ধৈর্য, সততা, সাহস এবং বিশ্বাস।” লীনার সঙ্গে বন্ধুত্ব আরও গভীর হয়েছে। সে শিখল, স্বপ্ন পূরণের পথে সাহস, সতর্কতা এবং ভালো মানুষদের সহযোগিতা অপরিহার্য। নদী তার জন্য শুধুই জল নয়, জীবনের শিক্ষক, পথপ্রদর্শক এবং শক্তি। প্রতিটি ঢেউ, প্রতিটি স্রোত, প্রতিটি ঝড়—সবই তাকে স্বপ্নের দিকে এগোয়। জলরাশি অধ্যায় ২৩: পরিকল্পনা ও নতুন অভিযান সুমনের জীবনে এসেছে নতুন অধ্যায়—পরিকল্পনা ও নতুন অভিযান। ঝড়ের পরীক্ষা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং প্রথম বিজয় তাকে শিখিয়েছে, সফল হতে হলে কেবল কঠোর পরিশ্রম নয়, পরিকল্পনাও অপরিহার্য। সুমন ও রবিউল বসে নদীর ধারে আলোচনা করল—কিভাবে আরও ভালোভাবে মাছ ধরা যায়, নৌকা ও জালের ব্যবহার উন্নত করা যায়। সুমন ভাবল, “আমি এখন শুধু মাছ ধরছি না, জীবনের কৌশল শিখছি। পরিকল্পনা ছাড়া বড় ঝড় মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।” বাবা বললেন, “পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি মানুষকে ঝড়ের মতো বিপদ থেকে রক্ষা করে। সাহস, ধৈর্য এবং কৌশল—সব মিলিয়ে একটি সফল অভিযান গড়ে উঠে।” নতুন অভিযান শুরু হলো। সুমন এবং রবিউল দূরের নদীর অংশে গেল। প্রতিটি জাল ছোঁড়া, প্রতিটি মাছ ধরা, প্রতিটি স্রোতের বিশ্লেষণ—সবই ছিল পরিকল্পনার ফল। সাফল্য আসছে ধীরে ধীরে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে। গ্রামের বুড়ো জেলেরা বলল, “পরিকল্পনা এবং ধৈর্যই সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। সাহস থাকলে, নদীর যেকোনো অংশে অভিযান সফল হয়।” অধ্যায় ২৪: জীবনের জলরাশি সুমনের দীর্ঘ যাত্রা—নদী, ঝড়, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বন্ধুত্ব, প্রেম, স্বপ্ন এবং সাহস—সব মিলিয়ে জীবনের জলরাশি হয়ে উঠেছে। নদীর ধারে বসে সে ভাবল, “জীবন নদীর মতো—শান্তও, উত্তালও। প্রতিটি ঢেউ, প্রতিটি স্রোত আমাদের শেখায় ধৈর্য, সততা, সাহস এবং সহযোগিতা।” বাবা পাশে এসে বললেন, “সুমন, তুমি শিখেছো—পরিশ্রম, ধৈর্য, বন্ধু এবং পরিকল্পনা মিলেই জীবনের প্রতিটি ঝড় অতিক্রম করা যায়। প্রকৃত বিজয় মানে শুধুই মাছ ধরা নয়, জীবনকে সুন্দরভাবে বোঝা।” লীনার চোখে সুমন দেখল স্বপ্নের আলো, বন্ধুত্বের শক্তি এবং ভালোবাসার উষ্ণতা। রবিউলও পাশে দাঁড়িয়ে শক্ত হাত ধরেছে। সুমন বুঝল—জলরাশি শুধু নদীর জল নয়; এটি জীবনের প্রতিটি শিক্ষা, প্রতিটি সম্পর্ক, প্রতিটি স্বপ্নের মিলিত রূপ। ঝড়, শান্তি, বিপদ, বিজয়—সব মিলিয়ে জীবনের সম্পূর্ণ রূপ। নদী তাকে শিখিয়েছে—ভয়কে বন্ধুবান্ধবের মতো গ্রহণ করো, সাহসী হও, ধৈর্য ধরো, স্বপ্ন দেখো এবং সর্বদা প্রস্তুত থাকো। জীবন নদীর মতোই অপ্রত্যাশিত, কিন্তু সঠিক মনোভাব থাকলে প্রতিটি ঢেউ অতিক্রম করা যায়। সুমন হাসল। নদীর জল তার হাতে স্পর্শ করল। নদী যেমন অবিরাম বয়ে চলে, তেমনি সুমনের জীবনও জলরাশি-এর মতো অবিরাম শেখায়, সমৃদ্ধ করে এবং শক্তি জোগায়।
0 Comments