রাত তখন ঠিক বারোটা বেজে সতেরো মিনিট।ঢাকা শহরের এক প্রান্তে, গুলশান ২-এর একটি পুরনো ফ্ল্যাটের ছাদের জানালা খোলা ছিল।বাতাসে কাঁপছিল সাদা পর্দা,টেবিলের উপর আধখাওয়া কফি ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে।রিয়া হোসেন ল্যাপটপের সামনে বসে রিপোর্ট লিখছিলেন—“নারীদের নিরাপত্তা: শহরে নিঃসঙ্গতা ও ভয়।”ঠিক সেই সময় ফোনটা কেঁপে উঠল।স্ক্রিনে নামটা দেখেই রিয়া কেঁপে উঠল—“আরিফ...তার কণ্ঠ কেঁপে উঠল, “তুমি? এত রাতে ফোন?”অপর প্রান্তে কণ্ঠটা নরম, প্রায় ফিসফিসিয়ে“তুমি আমার গল্পটা লিখেছ, কিন্তু শেষটা ভুল লিখেছ রিয়া।” রিয়া ভ্রু কুঁচকে বলল, “কি বলছ? কোন গল্প?”এক মুহূর্তের নীরবতা। তারপর— “যেখানে আমি মারা গিয়েছিলাম—তুমি ওরা সবাই মিলে আমায় ফেলে গিয়েছিলে মনে নেই?”রিয়া চমকে উঠল।মাথার ভেতর যেন বহুদিন আগের ছবি ভেসে উঠল—স্কুলের পেছনের দিকের সেই বিকেলটা,বৃষ্টির মধ্যে এক ছেলেটা পড়ে গিয়েছিল,ওরা চারজন দৌড়ে পালিয়েছিল। তুমি কে?” — কাঁপা গলায় রিয়া বলল।ফোনের ওপাশে কণ্ঠটা ঠান্ডা—আমি তখন মারা গিয়েছিলাম, আজ ফিরেছি চারটি নাম লিখে নিতে।ঠিক তখনই—রুমের লাইট টিমটিম করে নিভে গেল।জানালা দিয়ে হাওয়ার দমকা, আর এক নিমিষে ছুরির ঝলক—রিয়ার কণ্ঠ স্তব্ধ।পরদিন সকাল।ইন্সপেক্টর রুবায়েত খান ফ্ল্যাটের ভেতর পা রাখলেন।চারিদিকে সাংবাদিক, পুলিশের ব্যস্ততা।রিয়ার ল্যাপটপে সর্বশেষ টাইপ করা বাক্যটি স্ক্রিনে ঝলমল করছিল— কেউ আমার নাম নিচ্ছে, আমি ভয় পাচ্ছি। রুবায়েত মাথা নিচু করে বললেন,সম্ভবত ছুরি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। শরীরে একবারই আঘাত, গলা বরাবর।একজন অফিসার ছুরিটা হাতে ধরলেন,বললেন, “স্যার, ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেছে।”“কার? আরিফ হোসেন, স্যার। মিরপুরের ল্যাব টেকনিশিয়ান। রুবায়েত হতভম্ব— তাহলে গ্রেপ্তার করো। দুই ঘণ্টা পর জানা গেল—আরিফ সেই রাতে ল্যাবে ডিউটিতে ছিল।সিসিটিভিতে স্পষ্ট দেখা গেছে সে কোথাও যায়নি।তবুও ছুরির উপর তার হাতের ছাপ স্পষ্ট। রিয়ারের মৃত্যুর ৩ ঘণ্টা পর মিরপুরে আরেক তরুণী, মিলা রহমান, নিজের ছোট ঘরে খুন হলেন একইভাবে।ছুরি, একই আঘাত, আর ফিঙ্গারপ্রিন্ট—আবার সেই আরিফ হোসেনের। রুবায়েত এবার বুঝলেন, এটা সাধারণ খুন নয়। একজন মানুষ একসাথে দুই জায়গায় কিভাবে খুন করতে পারে? তিনি সাহায্য চান ড. মেহজাবিন আরার কাছে— একজন মনোবিজ্ঞানী, যিনি অপরাধমনস্তত্ত্ব নিয়ে কাজ করেন। মেহজাবিন বললেন,যদি শারীরিকভাবে না পারে, তাহলে হয়তো মানসিকভাবে কেউ তার শরীর নিয়ন্ত্রণ করছে…হয়তো অন্য কোনো চেতনা। রুবায়েত খুঁজে পান পুরনো স্কুলের রেকর্ড।চার তরুণীই একসময় পড়ত সেন্ট এঞ্জেল’স স্কুল-এ।তাদের ক্লাসে ছিল এক ছাত্র—আরিফ হোসেন।২০১১ সালে এক দুর্ঘটনায় সেই আরিফ ডুবে মারা যায় স্কুল পিকনিকে। আর তখন উপস্থিত ছিল এই চার মেয়ে। স্কুলের পুরনো নোটবুকে এক জায়গায় পাওয়া যায় লেখা—যারা আমার নাম ভুলে যাবে, আমি ওদের ভুলতে দেব না। রুবায়েত নিঃশব্দে বললেন, তাহলে এই খুনের শুরু এখান থেকেই। তৃষা হক, চার তরুণীর মধ্যে একমাত্র জীবিত তখনও। রুবায়েত তাকে সুরক্ষায় রাখেন,কিন্তু তৃষা ক্রমশ মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে থাকে।রাতে ঘুম ভেঙে সে দেখে— জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে এক পুরুষ ছায়া বলছে, তুমি পালিয়ে বাঁচবে না, তৃষা।সে চিৎকার করে উঠে জেগে ওঠে, কিন্তু কেউ দেখতে পায় না ছায়াটাকে। তারপর সকালে— তার কফি মগের নিচে একটা লেখা পাওয়া যায়— ১২টা ১৭ মিনিটে দেখা হবে।সায়মা ইসলাম, চিত্রশিল্পী,নিজের স্টুডিওর দেয়ালে একদিন আঁকছিল মুখবিহীন চারটি মেয়ে ও এক ছায়া মানুষ। সেই আঁকাটাই তার শেষ সৃষ্টি। রাত ১২টা ১৭ মিনিটে স্টুডিওর দরজার ভেতর থেকে আওয়াজ— কোনো লড়াই নয়, শুধু একবারের আঘাত। পরদিন রুবায়েত পৌঁছে দেখেন—দেয়ালের ছবিতে নতুন রঙে লেখা— সব শেষ হয়নি। ড. মেহজাবিন আরিফকে সেশনে বসান।হিপনোথেরাপিতে আরিফ বলল—“আমার মনে হয় আমি দু’জন মানুষ...একজন আমি, আর একজন সে, যে আমাকে ডাক দেয় রাতে।”সে নিজের ভাইয়ের গল্প বলে—“আমার এক জমজ ভাই ছিল, ওর নামও ছিল আরিফ... ও মারা গেছে পুকুরে, কিন্তু মাঝে মাঝে আমি তার কণ্ঠ শুনি। সে বলে, আমি বেঁচে আছি।”মেহজাবিন তাকিয়ে দেখলেন—আরিফের চোখের ভেতর যেন অন্য কারও উপস্থিতি।তদন্তে প্রকাশ পায়,আরিফ নিজের অবচেতনে তৈরি করেছে চারটি “ব্যক্তিত্ব”—প্রতিটি সেই মেয়েদের প্রতিশোধের প্রতিরূপ।তার দেহ ব্যবহার করে তারা একে একে হত্যা করেছে নিজেদের অপরাধবোধ মেটাতে।প্রতিটি খুনের সময় আরিফ ঘুমন্ত ছিল—কিন্তু তার মন জেগে ছিল অন্য এক সত্তায়।রুবায়েত মেহজাবিনের সহায়তায় আরিফকে “রিগ্রেশন হিপনোসিস”-এ পাঠান। সে অতীতের মুহূর্তে ফিরে যায়—স্কুলের পুকুরঘাট, চার মেয়ে পালাচ্ছে,একটি ছেলে চিৎকার করছে—“আমাকে টানো!”কেউ ফিরে তাকায় না। সেই চিৎকারই রয়ে যায় তার মস্তিষ্কে— এক প্রতিশোধে ভরা চেতনা হয়ে।তৃষার ঘড়ি থেমে যায় রাত ১২টা ১৭-তে।সে জানে, আজ তার পালা। রুবায়েত তাকে নিজের পাহারায় রাখেন, কিন্তু হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়।অন্ধকারের মাঝে এক কণ্ঠ বলে—আমার গল্প এখন শেষ। এক ছুরির ঝলক, তৃষা চিৎকার করে ওঠে—রুবায়েত দৌড়ে আসে, কিন্তু দেখে, ছুরি রক্তমাখা,আরিফ মাটিতে পড়ে আছে অচেতন অবস্থায়,তৃষা বেঁচে গেছে।আরিফকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সে চোখ খুলে একবার বলে—ওরা এখন শান্ত… আমার কাজ শেষ।তারপর চুপ করে যায়। মেশিনের বিট ধীরে ধীরে থেমে যায়। রুবায়েত নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকেন,তার পাশে মেহজাবিন বলেন, কখনো কখনো অপরাধবোধ মানুষকে এমন খুনি বানায়, যার অস্তিত্বই সে জানে না। দুই মাস পর, রুবায়েত একা অফিসে বসে রিপোর্ট লিখছেন। দেয়ালের ঘড়ি বাজল—১২টা ১৭।টেবিলের ফোনটা কেঁপে উঠল। স্ক্রিনে নাম—“রিয়া হোসেন” রুবায়েত ফিসফিস করে বললেন,“অসম্ভব...”ফোনের ওপাশে ঠান্ডা কণ্ঠ—ইন্সপেক্টর, গল্পটা তুমি শেষ করেছ, কিন্তু ছায়াটা এখনও ঘুমায়নি।লাইট নিভে গেল।
রাত তখন ঠিক বারোটা বেজে সতেরো মিনিট।ঢাকা শহরের এক প্রান্তে, গুলশান ২-এর একটি পুরনো ফ্ল্যাটের ছাদের জানালা খোলা ছিল।বাতাসে কাঁপছিল সাদা পর্দা,টেবিলের উপর আধখাওয়া কফি ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে।রিয়া হোসেন ল্যাপটপের সামনে বসে রিপোর্ট লিখছিলেন—“নারীদের নিরাপত্তা: শহরে নিঃসঙ্গতা ও ভয়।”ঠিক সেই সময় ফোনটা কেঁপে উঠল।স্ক্রিনে নামটা দেখেই রিয়া কেঁপে উঠল—“আরিফ...”
0 Comments