যে যান্ত্রিক কোলাহলপূর্ণ জীবনের জন্য নিজেকে উজার করে দিচ্ছেন, যে জীবনের সপ্নে বিভোর থাকছেন সারা সময়, এমন কি হতে পারে না, হয়তো সে জীবনটা কোনও পরাবাস্তব সত্তার সৃষ্ট বিভ্রম?
১. উদাস ভঙ্গিতে বাস স্টপেজে এসে দাঁড়ালো রাজিন। তার দাঁড়ানোর ভঙ্গি অনেকটা নিশ্চল, যেনো গায়ের সমস্ত ভর ছেড়ে দিয়েছে দুই পায়ের উপর।নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উপরের দিকে তাকালো একবার, তারপরই মুখ নামিয়ে নিলো। পবিত্র আলোর পরাজয় ঘটছে ধীরে ধীরে, অন্ধকার গ্রাস করে নিচ্ছে চারপাশের পৃথিবীকে। দিনের আলো প্রায় নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যা নেমে আসছে এই যান্ত্রিক শহর জুড়ে। স্টপেজে বাস এসে দাঁড়ালো একটা, প্রায় অর্ধেক পূর্ণ। বসার জায়গা পাওয়া যাবে না হয়তো। বেশি চিন্তা করার সময় পেলো না রাজিন। বাস থামতেই সেটাকে লক্ষ করে খানিকটা হুড়োহুড়ি করে এগিয়ে যাওয়া শুরু করেছে বাড়িফেরত জীবনযুদ্ধে পরাজিত মানুষের ছোট একটা দল।রাজিনও এই হোমো সেপিয়েন্সদের দলে সামিল হলো। অনেকটা ধাক্কাধাক্কি করেই বাসে উঠতে হলো তাকে। প্রায় অর্ধপূর্ণ বাসটি মুহূর্তেই ভরে উঠল মানুষ দ্বারা। মানুষের কোলাহল, যানবাহনের হর্ন ইত্যাদি শব্দ চারপাশে একটা বিরক্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি করলো। মানুষদের এই শহুরে কর্মব্যস্ততার মাঝে নিজেকে খানিকটা দিশেহারা মনে হলো শৈশবের পুরোটা সময় গ্রামে কাটানো রাজিনের।কোনমতে একটা নোংরা সিটের উপর হাত রেখে খানিকটা জায়গা করে দাঁড়াতে পারলো সে। নিজে থেকেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো তার মুখ থেকে। রং উঠে যাওয়া পুরোনো বাসটির নীরব আর্তনাদ কারো কানে পৌঁছালো না। ইঞ্জিনে জান্তব গর্জন তুলে সামনের রাস্তা ধরে আগানো শুরু করলো সেটি। বাসের মধ্যকার কোলাহল থেকে নিজেকে দূরে রাখতেই চিন্তার ট্রেন ছেড়ে দিলো রাজিন। মুহূর্তে নানা চিন্তায় তার মস্তিষ্কের ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠ পূর্ণ হয়ে উঠল। বর্তমানে কিছুই ভালো লাগছে না রাজিনের। শহুরে যান্ত্রিক জীবনে নিজেকে অভ্যস্ত করে নিতে পারেনি সে এখনো।গ্রাম থেকে চাকরি করতে শহরে এসেছে খুব বেশি দিন হয়নি। এক বছরের মতো কেটে গিয়েছে, হয়তো আরো বেশি, হিসাব করার চেষ্টা করলো না সে। সময় জিনিসটা সবসময়ই বড় রহস্যময় তার কাছে। অফিসের নিচু পদে চাকরি করার ঝামেলাসমূহ কেউ তাকে খুলে বলেনি আগে। প্রতিদিন বসের তোষামোদি করার পরেও দিন শেষে তার বকা শুনতে হবে, এমনটা জানলে এই ব্যস্ত শহরে কাজ করতে আসতো না সে। একটু আগেই সামান্য কারণে বসের ঝাড়ি খেতে হয়েছে তাকে। সিনিয়র সব কলিগদের সামনে তাকে ইচ্ছামত বকা দিয়েছেন ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের সিনিয়র ম্যানেজার ইশরাক আহমেদ। ওই মুহূর্তে প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছিল রাজিনের। কলিগরা কিছুটা সহানুভূতি আর অনেকটা অবজ্ঞার চোখে তাকিয়ে ছিল তার দিকে। প্রচণ্ড খারাপ লাগছিল তার। ইচ্ছা করছিল সে মুহূর্তেই ভুঁড়ি সর্বস্ব বস পদবীর লোকটার মুখে পদত্যাগপত্র ছুঁড়ে দিয়ে চাকরি থেকে ইস্তফা দিতে। কিন্তু পারেনি সে। বস ঠিকই বলেছেন মনে হয়। সে আসলেই হয়তো একটা নর্দমার কীট, যার নিজের আত্মসম্মানবোধ বলতে কিছু নেই। এই জগতে মানুষ যা করতে চায়, সেটা সে কখনোই করতে পারে না।তাই পুরোটা তাকে সময় মাথা হেলে চুপচাপ বসের কথা শুনতে হয়েছিল। তারপরই ইশরাক আহমেদকে দুঃখিত বলে মাথা হেলেই অফিস থেকে বের হয়ে এসেছে সে। এখন এই মুহূর্তে প্রচণ্ড গরমে বাসের অসহ্য চাপাচাপির মধ্যে দাঁড়িয়ে এই কথা চিন্তা করার মানে হয় না, জানে রাজিন। তবুও মাথার মধ্যে অপমানের চিন্তাটা বার বার ঘুরে ফিরে আসছে, আর প্রত্যেকবারই প্রচণ্ড খারাপ হয়ে উঠছে তার মেজাজ। একটা মেসে থাকে সে বর্তমানে। আব্বা আম্মা গ্রামের বাড়িতে।বিয়ে করেনি সে, বিয়ের কথা চলছে। যদিও এই মুহূর্তে রাজিন বিয়ের কথা চিন্তা করতে রাজি না। নিজেই ঠিকভাবে মাস চালাতে পারে না, নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে খাওয়াবে কি। সামনের মাসে বেতন পেলে মায়ের জন্য একটা শাড়ি কিনবে সে, আব্বার জন্য কেনা লাগবে ঔষধ। ক্যান্সার ধরা পড়ার পর গাদা গাদা ঔষুধ খেতে হচ্ছে মানুষটিকে। নানা ভাবনা - দুশ্চিন্তায় নিজেকে মগ্ন করে ফেললো রাজিন। সে দুশ্চিন্তার কুফল সম্পর্কে জানে না, জানলে এই কাজ কখনও করত না। গভীর ভাবনায় মগ্ন থাকার কারণে সময় কোন দিক দিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে, খেয়াল করলো না সে। চারপাশের পরিবেশ অনেকটা ধোঁয়াটে হয়ে উঠল তার কাছে। বাসের মধ্যকার অসুস্থ পরিবেশ থেকে নিজেকে আলাদা করে চিন্তার বুদ বুদে ভাসতে থাকলো সে। চারপাশের পরিবেশে যে খানিকটা পরিবর্তন এসেছে এবং ক্রমাগত ক্ষুদ্র পরিবর্তন হয়ে চলেছে, সেটা খেয়াল করলো না সে। বাসের ভিতরে ঝপ করে ঠান্ডা নামলো, যেনো কেউ তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে নামিয়ে দিয়েছে। যাত্রীদের কোলাহলও থেমে গেলো যেনো হঠাৎ করে।পরিবেশের এই পরিবর্তন টের পেতেই বাস্তবে ফিরে আসলো রাজিন। চারপাশে তাকালো। বাইরের জগতে কালীগোলা ভীষণ অন্ধকার নেমেছে, জানলার ফাঁক দিয়ে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আজকে কি অমাবস্যা? বাসের ভিতর একটা লাইটও জ্বলছে না, নষ্ট হয়তো। কিন্তু চারপাশের পরিবেশ এত শান্ত লাগছে কেনো তার কাছে?বাসটাও হঠাৎ চলা বন্ধ করে দিলো। কিন্তু গতি জড়তা একটুও টের পেলো না সে। প্রচণ্ড ভয়ের একটা অনুভূতি রাজিনের ইন্দ্রিয় জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। পায়ে কাঁপুনি শুরু হলো তার, হৃৎপিণ্ডের দুর্বার স্পন্দনও অনুভব করতে পারল বেশ ভালোভাবেই। মানুষ অজানাকে ভয় পায়, অজানাকে উপভোগ করার ক্ষমতা খুব বেশি মানুষের থাকে না।রাজিন বিশেষ কোনো মানুষ নয়। এবং তার চারপাশেও অজানার উপস্থিতি, যার মুখোমুখি সে কোনোদিনও হয়নি। এতক্ষণ বাসের যাত্রীদের চেহারা তার নজরে আসে নি। কিন্তু তাদের একজনের মুখের দিকে চোখ যেতেই তার বুকের কাঁপুনি বেড়ে গেলো যেনো। গা শিউরে উঠার মত শীতল চাহনি মানুষটার, সম্পূর্ণ অনুভূতিহীন। যেনো মৃত কোনো মানুষের দিকে তাকিয়ে আছে সে। মানুষটার চোখের নির্লিপ্ত দৃষ্টি তার দিকেই নিবদ্ধ। তার পাশের জনের দিকে তাকালো রাজিন। নাহ, প্রত্যেকটা মানুষের চোখের চাহনি একই ঠেকছে তার কাছে। কেউ বসে আছে সিটে, কেউ আছে দাঁড়িয়ে, কিন্তু মৃত শীতল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে প্রত্যেকটি মানুষ। সে যেদিকেই সরছে, মানুষগুলোর চোখের দৃষ্টি ঘুরে তার উপর নিবদ্ধ হচ্ছে। এই পরাবাস্তব পরিবেশে নিজেকে বড় অসহায় মনে হলো রাজিনের। এতজন মৃত মানুষের শীতল দৃষ্টির সামনে নিজেকে নগ্ন মনে হতে থাকলো। মনে হলো এগুলা আসলে মানুষ না, বরং প্রাচীন কোনো পরাবাস্তব অতীন্দ্রিয় সত্তা তার দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তার সারা জীবনের ভালো মন্দ সব কাজের হিসাব নিচ্ছে। সে একটু একটু করে মানুষগুলোকে সরিয়ে বাসের দরজার দিকে সরে আসতে থাকলো। তাও ভালো, মানুষগুলো তাকে বাধা দিচ্ছে না। শুধু অসহ্য একটা ভঙ্গিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। একটু সরে আসতেই দরজার দিকে ছুট লাগলো সে। মানুষদের প্রচণ্ড হুড়োহুড়ির মাঝেই দরজার দিকে এগোতে থাকলো। পালাতে হবে তাকে, এই পরাবাস্তব পরিবেশ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হবে। মাথার ভিতর পাগলা ঘন্টি বাজাতে শুরু করেছে কেউ, সারভাইভাল ইনস্টিক্ট কাজ করতে শুরু করেছে তার জন্য। অন্ধকারে ভালো ভাবে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে অন্ধকার বাড়ছে তার চারপাশে। আঁধারের মধ্যেই দরজা যেদিকে হওয়ার কথা, সেদিকে আন্দাজে হাত বাড়িয়ে দিলো সে। ধাতব একটা দেয়ালের স্পর্শ পেলো। নেই, দরজা নেই সেখানে। বাসের দরজা সর্বদা খোলা থাকার কথা থাকলেও এখানে কোনো কিছুর উপস্থিতি নেই, স্রেফ ধাতব দেয়াল।রাজিনের হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন যেনো এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেলো। তারপরই পাগলের মত দুহাতে আন্দাজে ধাতব দেয়ালের মধ্যে হাতড়িয়ে চলল, কোনো দরজা সদৃশ কিছুর স্পর্শ যদিও তার হাত পেলো না। দুর্দমনীয় নিখাঁদ একটা আতঙ্ক তার মস্তিষ্কের গহীন কোণ থেকে তীব্র স্রোতের মতো আছড়ে পড়ল সমস্ত ইন্দ্রিয় জুড়ে। বাসের দুইপাশের জানালাগুলোর দিকে তাকালো সে, বন্ধ সবগুলো। মোটা কাচের মধ্যে দিয়ে বাইরে দেখা যাচ্ছে স্রেফ নিকষ অন্ধকার। ঢোক গিললো রাজিন। ভয় পাচ্ছে সে, প্রচণ্ড ভয়। এই ভয়ের সৃষ্টি অজানা কোনো জগতে, ভিন্ন কোনো মাত্রায়। তাকে বন্দী করে ফেলা হয়েছে এই বাসের মধ্যে, মৃত অনুভূতিহীন এক দল মানুষের মাঝে।এই চিন্তা তার মাথায় আসতেই অসহায়ত্ব বোধটা আরো বেড়ে গেলো। তার মস্তিষ্ক এখন প্রায় লাফাতে শুরু করেছে। তার পিছনে একটা সো সো শব্দ শোনা যাচ্ছে এখন। শব্দের উৎপত্তি লক্ষ করে পিছনে ফিরে তাকালো রাজিন। অজানাকে ভয় পায় মানুষ, অজানার সামনে দাঁড়িয়ে নিখাঁদ আতঙ্ক অনুভব করে। কিন্তু সেই অজানার উপস্থিতি যদি তার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন আর আতঙ্কটা সেরকম ভয়াবহ লাগে না। নিজেকে নিয়তির হাতে সপে দিতে ইচ্ছা করে, যেই স্রষ্টা তাকে সৃষ্টি করেছে, সেই স্রষ্টার উপর ভরসা করে সে। রাজিনের ও একই অনুভূতি হলো পিছনে ঘুরে তাকানো মাত্রই। সে দেখলো বাসের পিছনের অংশে নিকষ অন্ধকার এক কুয়াশার সৃষ্টি হয়েছে, ঘন আঁধারে পতিত হয়েছে পিছনের সবকিছু।সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো অন্ধকার মেঘটা এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে, চারপাশের সবকিছুকে গ্রাস করে নিয়ে। যেনো জিনিসটা একটা ক্ষুদ্র আকৃতির ব্ল্যাকহোল, যার মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে সবকিছু, অনন্তকালের জন্য। সময়, কাল, মাত্রা সবকিছুকে ভেঙে দিয়ে গম্ভীর অলস ভঙ্গিতে অন্ধকার মেঘটা এগিয়ে আসছে, যেনো জানে পালাতে পারবে না রাজিন এখান থেকে। রাজিন হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল বাসের মেঝেতে। লাভ নেই আর কোনো, এই পরাবাস্তব পরিবেশ তার সহ্যসীমার বাইরে। ভয় লাগছে না আর তার। বরং সামনের যে দৃশ্য সে দেখতে পাচ্ছে,ক্রমাগত এগিয়ে আসা অশুভ অন্ধকারে পতিত হচ্ছে চারপাশের সবকিছু, তার মাঝে বাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা এক দল মানুষ তার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, এ সবকিছুই তার কাছে একটা স্বপ্ন মনে হতে থাকলো। যেনো এই অন্ধকারের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেই স্বপ্নের সমাপ্তি ঘটবে, ঘুম ভেঙে যাবে তার। হঠাৎ বাসটা ভীষণ রকম দুলে উঠল। তারপরই রাজিনের মনে হতে থাকলো বাসটা শূন্যে ভেসে উঠছে। একটা সিটের নিচের অংশ আঁকড়ে ধরলো সে। বাসের মধ্যকার মৃত দৃষ্টির মানুষগুলো হঠাৎ যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে, তাদের আর দেখা যাচ্ছে না। বাতাসের সো সো শব্দটা অস্বাভাবিক পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে, কানে তালা লাগিয়ে দিয়েছে রাজিনের। হঠাৎ ঘন অন্ধকার কুয়াশার গতিবেগ বেড়ে গেলো যেনো। চারপাশের সবকিছুকে নিজের মধ্যে শুষে নিয়ে তেড়ে ফুঁড়ে তার দিকে এগিয়ে আসতে থাকলো।ঘন কুয়াশার তাণ্ডবে চারপাশে বাসের দেয়াল দুমড়ে মুচড়ে যেতে থাকলো। কাঁচগুলো ভেঙে পড়ল, লোহার শিকল বেঁকে যেতে শুরু হলো। প্রচণ্ড দুলতে থাকা বাসের মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ল রাজিন। চোখে অন্ধকার থেকে শুরু করেছে। বুঝতে পারলো সে, জ্ঞান হারাচ্ছে। কোনো মতে চোখ খুলে রাখলো সে, দেখতে পেলো চারপাশের পরিবেশকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়ে তাকে গ্রাস করে নিতে এগিয়ে আসছে পরাবাস্তব এক অশুভ অন্ধকার।সম্পূর্ণ জ্ঞান হারানোর আগে সেই আঁধারের মধ্যে নিজের উপস্থিতি কিঞ্চিৎ টের পেলো সে। আহ, চারপাশ সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ আর শান্ত। বাইরের পৃথিবীর বিশৃঙ্খলা এই পরাবাস্তব আঁধারে পৌঁছাচ্ছে না। জ্ঞান হারিয়ে ফেললো রাজিন। কিন্তু তার আগে তার মুখ দিয়ে যে নিশ্বাসটা বের হলো, সেটা স্বস্তির না দুর্ভাবনার, এর উত্তর লেখক হয়তো নিজেও জানেন না। ২. ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো রাজিন। অ্যালার্ম এর কর্কশ ধ্বনি, বাইরের শহরের যান্ত্রিক কোলাহল, দেয়াল ঘড়ির টিক টিক শব্দ, সবকিছু তার মস্তিষ্কে আছড়ে পড়ল। বিছানার পাশের টেবিল থেকে অ্যালার্ম ঘড়িটা হাতে তুলে নিল সে। সকাল সাড়ে সাতটা বাজে। হাই তুলল একটা, নিজের বিছানায় উঠে বসলো।নাদিয়া নেই তার পাশে। হয়তো রান্নাঘরে, সকালের নাস্তা বানাচ্ছে। অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখছিল এতক্ষণ।স্বপ্নের সময়কাল অনেক বছর আগের, প্রায় ১০ বছর পেরিয়েছে তারপর। সে এখন ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল এ নেই, কয়েক বছর আগে যোগ দিয়েছে হেপটা ফার্মাসিউটিক্যালস এ, সিনিয়র ম্যানেজার পদে। বিয়ে করেছে সে, নাদিয়ার মত মিষ্টি একটা মেয়েকে। বয়সের সাথে বেড়েছে তার পেটের মেদ। আব্বা আর বেঁচে নেই, ক্যান্সারের কাছে হার মেনেছেন। আম্মা এখনো বেঁচে আছেন, নিজের ভিটেমাটিকে আঁকড়ে ধরে। আহ, ঘোর লাগা ভাবটা ফিরে আসছে, মাথা ব্যাথা করতে শুরু করেছে। তিন মাস ধরে এই সমস্যায় ভুগছে রাজিন। ঠিকভাবে চিন্তা করতে পারে না তার মস্তিষ্ক, মাথার মধ্যে সবসময় একটা ফাঁকা ফাঁকা ভাব থাকে। এর সাথে কয়েক ঘণ্টা পর পর যুক্ত হয় মাথা ব্যথা। জীবনেও নেশা দ্রব্য ছুঁয়ে দেখেনি সে, কিন্তু এখন প্রায় পুরোটা সময় নেশাখোরদের মত ঘোর লাগা অনুভূতি হয় তার। ডাক্তার দেখিয়েছিল, দেশসেরা একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। মডারেট অ্যাংজাইটি ধরা পড়েছে তার। নিঃশ্বাস- প্রশ্বাসের ব্যায়াম করতে বলা হয়েছে তাকে। সাথে দেওয়া হয়েছে এক গাদা ওষুধ। ডাক্তারের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল সে। চাকরি জীবনের শুরু থেকেই নানা বিষয়ে দুশ্চিন্তা করে আসছিল সে, কিন্তু তার ফলাফল যে এমন হবে জানত না। সারাদিন প্রচণ্ড ঘোর লাগা ভঙ্গিতে বসে থাকতে আর ভালো লাগে না তার, মস্তিষ্ককে মনে হয় ফাঁকা মাঠ। যখন কিছু লেখতে যায়, মাথায় শব্দ আসে না। আগের দিনের ঘটনা পরের দিন মনে রাখতে পারে না। নিজের অতীত স্মৃতিকে মনে হয় ধোঁয়াটে কিছু। কিছুক্ষণ আগে স্বপ্নে যা দেখেছিল, সেটা বাস্তবেই ঘটেছিল কিনা তার সাথে, মনে নেই আর। সেটা নিয়ে চিন্তা করতে যাবে, সেই সুযোগ নেই। নিজের মস্তিষ্ক তাকে এ ব্যাপারে চিন্তা করতে বাধা দেয় প্রতিনিয়ত। ভার হয়ে থাকা মস্তিষ্ক নিয়েই সে উঠে বাথরুমে গেলো। চোখ, মুখে পানি দিলো। আজকে অফিসে একটা প্রেজেন্টেশন আছে তার, কীভাবে করতে পারবে জানে না সে, নূন্যতম কোনো প্রস্তুতি নেয় নি। চাকরিটা মনে হয় আর থাকে না। ধুরো, আবার দুশ্চিন্তা করছে সে। বাথরুম থেকে বের হয়ে ডাইনিং রুমে এসে ঢুকলো। নাদিয়া রান্নাঘরে, নাস্তা বানাচ্ছে। তার উপস্থিতি টের পেয়ে বলল, “একটু অপেক্ষা করো। রুটি প্যানে বসিয়েছি।”মেয়েটার গলার স্বর অনেকটা যান্ত্রিক আর দূর মনে হলো রাজিনের কাছে, ভালোবাসার কোনো ছোঁয়া নেই তাতে।দীর্ঘশ্বাস ফেলল আবারো, মেয়েটা কি তার থেকে দিন দিন দূরে সরে যাচ্ছে? নিরাস ভঙ্গিতে নাস্তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলো সে। ৩. “বেচারা,” অবজ্ঞার ভঙ্গিতে বলল অ্যালিসা, মাথার উপর থেকে নিউরোলিংক হেডসেট টা খুলে রাখলো। পাশের পডে শুয়ে থাকা রাশানের দিকে তাকিয়ে অবজ্ঞার হাসি হাসল। পৃথিবী, তেইশ শতক, সেক্টর ৭৮। একসাথে ডেটে বের হয়েছে অ্যালিসা আর রাশান। রাশান তাকে নিয়ে এসেছে এই নিউরোলিংক পার্লারে। ঢাকা শহরে নিউরোলিঙ্ক প্রযুক্তি নতুন এসেছে কয়েক মাস আগে। শহরের অভিজাত এলাকায় কয়েকটা পার্লার খোলা হয়েছে, সেখানে এসে ভিড় জমাচ্ছে নানা বয়সের যুগল। এই যন্ত্রের মূল কাজ মানুষকে নানা প্রকারের অভিজ্ঞতা দেওয়া। এর ভার্চুয়াল লাইব্রেরিতে অতীত ও বর্তমানের বিভিন্ন মানুষের স্মৃতি জমা রাখা আছে।যন্ত্রের সাথে যুক্ত হেডসেট টা মাথায় পড়লে মানুষ সরাসরি যুক্ত হয় সেই স্মৃতিগুলোর সাথে, অন্য মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া অভিজ্ঞতা নিজে উপভোগ করার সুযোগ পায়। অন্য একজনের চোখে দেখতে পায় তার জীবনে ঘটে নানা ঘটনা। রাশানের অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল এই নিউরোলিংক যন্ত্রটা ব্যবহার করার। তাই আজকে ছুটির দিনে সে তার প্রেমিকা অ্যালিসাকে নিয়ে এসেছে এরকম একটা পার্লারে। যদিও এখানে এসে তাদের যারপরনাই হতাশ হতে হয়েছে। নিউরোলিংক এর উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান নেরিকো ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ের মানুষের অভিজ্ঞতাকে সংগ্রহ করে যে বৃহৎ লাইব্রেরি তৈরি করেছে, সেখান থেকে পার্লার গুলোকে অভিজ্ঞতাগুলো কিনতে হয় আলাদা টাকা দিয়ে। নিউরোলিংক এর সাথে শুধুমাত্র অল্প কয়েকটা একঘেয়ে অভিজ্ঞতা বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়। পুঁজিবাদী চিন্তাভাবনার ফসল যাকে বলে! এই তথ্যটা জানত না রাশান। তাই এই পার্লারে এসে এদের সংগ্রহে অল্প কয়েকটা ইন্টারেক্টিভ স্মৃতি দেখতে পেয়ে হতাশ হতে হয়েছে তাকে আর অ্যালিসাকে। অ্যালিসা এখান থেকে বের হয়ে অন্য কোথাও যেতে চাচ্ছিল। কিন্তু আবার কবে এটার অভিজ্ঞতা নিতে পারবে, সেটা জানে না রাশান। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় আজকেই এই নিউরোলিংক যন্ত্রটা ব্যবহার করার। পার্লারের অপর্যাপ্ত সংগ্রহের বেশিরভাগই অনেক একঘেয়ে হবে, বুঝতে পেরেছিল তারা। এগুলোর মধ্যে এই রাজিন সালেহ নামক লোকটার বাসের ভিতরের স্বপ্নের স্মৃতিটা তাদের কাছে আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। নাহলে একুশ শতকের একজন পুঁজিবাদী মানুষের একঘেয়ে জীবনের অভিজ্ঞতা উপভোগ করার ইচ্ছা তাদের ছিল না। অ্যালিসা শেষ পর্যন্ত নিমরাজি হয় এই স্মৃতিটা উপভোগ করতে। দুজনে একই স্মৃতি উপভোগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। গত প্রায় ১ ঘণ্টা ধরে দুজনে মিলে রাজিনের ভয়ংকর সেই স্বপ্নের স্মৃতি দেখছিল এতক্ষণ। “কেমন লাগলো?” কাউন্টারের সামনে বিল পরিশোধ করার সময় অ্যালিসার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো রাশান। মুখ বাকালো অ্যালিসা, “ভালো লাগেনি। স্বপ্নটা ভালো ছিল। কিন্তু বুঝতে পারিনি লোকটা এরকম দুশ্চিন্তায় ভুগছে। বেচারা!” মুচকি হাসলো রাশান, “লোকটার স্মৃতির ভেতর এতক্ষণ থাকার পর আমার মাথাও খানিকটা ভারী লাগছে।” “কেনো? তুমিও কি দুশ্চিন্তা করা শুরু করলে তাহলে?” হাসির জবাবে সুন্দর একটা মুচকি হাসি ফেরত দিলো অ্যালিসা। “কিছুটা বলতে পারো। আমরা কবে বিয়ের অনুমতি পাবো সরকার থেকে, সেটা নিয়ে খানিকটা দুশ্চিন্তা হচ্ছে বটে।” “থাক। আর দুশ্চিন্তা করতে হবে না,” বিল পরিশোধ শেষ হলে মূল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললো অ্যালিসা। “আমাদের হাতে এখনো প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় বাকি। কী করা যায় বলো তো?” পার্লার থেকে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো রাশান। “উম, চলো আইসক্রিম খাই।” মিষ্টি হেসে রশানের হাত ধরলো অ্যালিসা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রাশান। নিজেকে এখন একজন সুখী মানুষ মনে হচ্ছে তার। তাহলে জীবনের মানে কি তবে এই? জীবনে যেসব সুন্দর মুহূর্ত আসবে, সেই বিশেষ মুহূর্তগুলোকে উপভোগ করার জন্য বেঁচে থাকা? জানে না রাশান, জানার ইচ্ছা নেই তার। বরং স্রষ্টাকে একটা ধন্যবাদ দিলো সে, এরকম একটা সুন্দর মুহূর্ত তাকে উপহার দেওয়ার জন্য। অ্যালিসারও নিজেকে এই মুহূর্তে সুখী মনে হচ্ছে। নিজের ভালোবাসার মানুষের পাশে নিজেকে নিশ্চিন্ত মনে হচ্ছে। খুশি মনেই রাশানের হাতটা জড়িয়ে ধরলো, নিজের শরীরের খানিকটা ভার ছেড়ে দিলো রাশানের হাতের উপর। আহ, এই মুহূর্তটা এত সুন্দর কেনো? রাজিন নামের মানুষটার কথা আর মনে থাকলো না তাদের কারো। নিয়ন আলোয় উদ্ভাসিত ঢাকা শহরের পথ ধরে একে অপরের হাত ধরে হেঁটে যেতে থাকলো এক জোড়া কপোত কপোতী। তাদের মনে ক্ষীণ আশা, এই পথ যদি অনন্তকাল ধরে চলতো। স্রষ্টা মানুষের সব ইচ্ছা পূরণ করেন না। তবুও নিজের মনের মধ্যে কিছু উচ্চাকাঙ্ক্ষা পুষিয়ে রাখতে দোষ কোথায়?
যে যান্ত্রিক কোলাহলপূর্ণ জীবনের জন্য নিজেকে উজার করে দিচ্ছেন, যে জীবনের সপ্নে বিভোর থাকছেন সারা সময়, এমন কি হতে পারে না, হয়তো সে জীবনটা কোনও পরাবাস্তব সত্তার সৃষ্ট বিভ্রম?
0 Comments